মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ‘হাতিয়ার’ করে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপতিদের ভয় দেখানো হচ্ছে! হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে তাঁদের স্বাধীনতায়। কলকাতার ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্য সম্মেলন থেকে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রকে এই অভিযোগে আবার বিদ্ধ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদিনের বাণিজ্য সম্মেলনে রাজ্যের গত ১৫ বছরের শিল্প-সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেছেন মমতা। পাশাপাশিই অভিযওগ করেছেন, এজেন্সিকে দিয়ে রাজ্যের শিল্পমহলকে ভয় দেখানো হচ্ছে! বলেন, ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এ নিয়ে যারপরনাই আতঙ্কে রয়েছেন শিল্পপতিরা। মমতা বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীদের স্বাধীনতা দেওয়া হোক। সারাক্ষণ এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখালে ব্যবসা হবে কী করে? তাঁরা সব সময়ে ভয়ে থাকেন। সব ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। শিল্পপতি থেকে শুরু করে শ্রমিকশ্রেণি— সকলের জন্য স্বাধীনতা চাই। সকলে আনন্দে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। শ্রমিকেরাই রাজ্যের সম্পদ।’’
ঘটনাচক্রে, বুধবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ব্যবসায়ী সম্মেলনের আগে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-পরিস্থিতি নিয়ে সুর চড়িয়েছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যও একযোগে বলেছিলেন, রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বহু শিল্প সংস্থা। মমতা সরাসরি কারও নাম নেননি। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, বৃহস্পতিবারের শিল্প সম্মেলন থেকে তারই জবাব দিলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর ওই কথার পরেই হাততালি এবং হর্ষধ্বনি শোনা যায় প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে। অতীতে একাধিক বার রাজ্যের শাসকদলের বিভিন্ন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ‘সিন্ডিকেটরাজ’ চালানো ও তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছে। যে কোনও প্রকল্প শুরু করতে গেলে কাকে বরাত দিতে হবে, কোন কোন দোকান থেকে ইমারতি দ্রব্য কিনতে হবে, সে সব তৃণমূল পরিচালিত সিন্ডিকেটই ঠিক করে দেয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন তৃণমূলনেত্রী নিজেও। যে সূত্রের অনেকে মনে করছেন, ব্যবসায়ীদের ‘স্বাধীনতা’ চাওয়ার মধ্য দিয়ে দলের একাংশকেও বার্তা দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি অর্জন করতে চেয়েছেন বণিকমহলের আস্থাও। এরই পাশাপাশি নিন্দকদেরও আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ শান্তিপূর্ণ রাজ্য। যা শিল্পের জন্য জরুরি। মানুষ শান্তি, একতা, সুখনিদ্রা চায়। মনে শান্তি থাকলে মস্তিষ্কে অনেক ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’ আসে।’’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, সমাজমাধ্যমে রাজ্যের বিরুদ্ধে ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা নিয়ে বাংলার নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে।’’ পরিসংখ্যান তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন্দ্রের নীতি আয়োগের রিপোর্টই বলছে, গত সাড়ে ১৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ২ কোটি নিয়োগ হয়েছে। বেকারত্বও কমেছে ৪০ শতাংশ। মমতার প্রশ্ন, ‘‘যারা বাংলার নিন্দা করছে রাজনৈতিক স্বার্থে, এটা কি তাদের কাছে গর্বের নয়?’’
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটিই শেষ বাণিজ্য সম্মেলন। দেশবিদেশের শিল্পপতি থেকে শুরু করে বণিকমহলের প্রতিনিধিরা এসেছেন সেই সম্মেলনে। সেখানে গত ১৫ বছরে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ দেন মমতা। জানান, পর্যটনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে রাজ্য। দুর্গাপুজো ও কালীপুজোকে স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এ ছাড়া, শিলিগুড়িতে তৈরি হচ্ছে মহাকাল মন্দির। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সেখানে আসবেন মানুষ।
শুধু তা-ই নয়, মমতা জানিয়েছেন, এশিয়ার অন্যতম ‘লজিস্টিক্স’ হাব হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। এখানেই এশিয়ার বৃহত্তম চর্মশিল্প কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। ৩৭,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে সেখানে। কাজ পেয়েছেন প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষ। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পেও এক নম্বরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ধন্যবাদ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২,৮০০টি সংস্থায় প্রায় দু’লক্ষ কর্মী কাজ করছেন। এ ছাড়া, বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালির জন্য ৩৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। তৈরি হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর হাব। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্কা শিল্পস্থাপনের জন্য রাজ্যে ৬০০ একর জমি চেয়েছিলেন। উত্তরপাড়ায় তাঁর সংস্থার জন্য ৩৫০ একর জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। মমতা বলেন, ‘‘আমার বাইসাইকেল নিয়েও পরিকল্পনা আছে। আমরা মেয়েদের সাইকেল দিই। তাই প্রতি বছরে আমার প্রায় ১৬ লক্ষ সাইকেল দরকার হয়। সেটা বাইরের রাজ্য থেকে আনানো হয়। ওই সাইকেল রাজ্যেই উৎপাদন করা যেতে পারে।’’
দুর্গা অঙ্গনের শিলান্যাস ঘোষণা, সূচনা বড়দিনের উৎসবের
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে দুর্গা অঙ্গনের শিলান্যাসের দিনও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর বিকেল ৪টের সময় ওই অনুষ্ঠান হতে চলেছে। আয়োজক ‘হিডকো’। চলতি বছরের ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দুর্গা অঙ্গন তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা। অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেই সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিল রাজ্য মন্ত্রিসভা। তার পর দেরি না করে দরপত্র ডেকে দুর্গা অঙ্গন তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে আবাসন পরিকাঠামো উন্নয়ন পর্ষদ (হিডকো)। নিউটাউনের ইকো পার্কের অদূরে রামকৃষ্ণ মিশনের পাশে তৈরি হতে চলেছে দুর্গা অঙ্গন।
অন্যদিকে, এক সপ্তাহ আগেই বৃহস্পতিবার বড়দিনের উৎসবের সূচনা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে হল সেই অনুষ্ঠান। কলকাতার পাশাপাশি ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার গির্জাতেও উৎসবের উদ্বোধন করেছেন মমতা। দার্জিলিঙে ১৮৪৩ সালে তৈরি ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ়’ গির্জার সংরক্ষণের কাজ শেষ হয়েছে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে সেই গির্জারও উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, রাজ্যে এ বছর বড়দিন উদ্যাপন ১৫ বছরে পা দিয়েছে। এখন কলকাতার পাশাপাশি সব জেলায়ও বড়দিনের উৎসব পালন করা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সব উৎসব নিজেদের মনে করে পালন করি। এমনিতে অনেক টেনশন রয়েছে মানুষের জীবনে। একমাত্র এই উৎসবই মানুষকে টেনশন থেকে মুক্তি দিতে পারে।’’ বড়দিন উপলক্ষে এ বছর অ্যালেন পার্ক, পার্ক স্ট্রিট-সহ শহর এবং জেলার বিভিন্ন জায়গা ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সজ্জিত থাকবে। তবে ২৪ এবং ২৫ ডিসেম্বর অ্যালেন পার্ক বন্ধ থাকবে। ওই দু’দিন পর্যটক চলাচলের জন্য পার্ক স্ট্রিটে গাড়ি চলবে না। বসবে না খাবারের স্টলও।