কুলতলির মৈপীঠে ভুবনেশ্বরী প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অভিযোগ, এখানে চিকিৎসার সরঞ্জাম থাকলেও পরিকাঠামো তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। — নিজস্ব চিত্র।
ঘরে ঘরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে, মোবাইল টাওয়ার আছে, বিদেশি মদের দোকান আছে, রাস্তায় আলো আছে। নেই শুধু উন্নত মানের ট্রমা অ্যাম্বুল্যান্স, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপযুক্ত পরিকাঠামো। তাই বাঘের আক্রমণে কেউ জখম হলে তাঁর চিকিৎসা শুরু করতে করতেই পেরিয়ে যায় নিদেনপক্ষে এক থেকে দেড় ঘণ্টা।
এমনই দশা কুলতলির সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার।
এখানে উপদ্রব বাঘ, কুমির আর সাপের। তাই কুলতলি, মৈপীঠ, গোসাবার মতো এলাকার সমস্যাগুলোকে আর পাঁচটা জায়গার সঙ্গে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপলে ঘোরতর ভুল হবে। মৈপীঠের বৈকুণ্ঠপুর, দেবীপুর কিংবা গোসাবার লাহিড়ীপুর, লাক্সবাগান, বালি দ্বীপ, সীতাপুর, ঝড়খালি, বাসন্তীর মতো এলাকার বাসিন্দাদের সিংহভাগই মৎস্যজীবী। জঙ্গলে মীন, মাছ, কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘ-কুমিরের হানায় জখম হওয়ার ঘটনা এখানে আকছারই ঘটে। কিন্তু তার পরে জখম মানুষটির দ্রুত উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার কোনও সুযোগ কার্যত নেই বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষেরা। জখমদের অনেকে শুধু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মারা যান।
কুলতলি-মৈপীঠের কথাই ধরা যাক। স্থানীয়দের থেকে জানা গেল, এখানে বাঘের আক্রমণে কেউ জখম হলে অন্তত তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা উজিয়ে তাঁকে স্থানীয় জয়নগর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। জোটে না কোনও ট্রমা অ্যাম্বুল্যান্স, যার ভিতরে দ্রুত রক্ত বন্ধের ইঞ্জেকশন, অক্সিজেন কিংবা প্রশিক্ষিত নার্সের ব্যবস্থা থাকবে। অত্যন্ত সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে রোগীকে নিয়ে যেতে হয় গ্রামীণ হাসপাতালে। অনেক ক্ষেত্রে সেই অ্যাম্বুল্যান্সও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ। সে ক্ষেত্রে জখম শরীরটাকে মোটর-ভ্যানে চাপিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে গ্রামীণ হাসপাতালে পৌঁছতে হয়। ঝাঁকুনির চোটে ক্ষত থেকে আরও বেশি রক্ত পড়তে থাকে। কিন্তু গ্রামীণ হাসপাতালেও রোগীদের ভর্তি রেখে উন্নত চিকিৎসার তেমন কোনও পরিকাঠামো নেই। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা রোগীদের পাঠিয়ে দেয় কলকাতার এসএসকেএম, চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কিংবা নীলরতন সরকারমেডিক্যাল কলেজে।
এ সব কথা জানালেন জয়নগর-গোসাবা এলাকার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীরাই। তাঁদের মতে, প্রথমেই বোঝা দরকার যে, সুন্দরবনের এই সব প্রত্যন্ত এলাকায় সাধারণ দুর্ঘটনার পাশাপাশিই বোঝার উপরে শাকের আঁটির মতো রয়েছে বন্যপ্রাণীর হাতে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। গোসাবা, ঝড়খালির মতো জায়গায় মানুষ দ্বীপে বসবাস করেন। প্রথমে সেখান থেকে নদী পেরিয়ে রোগীকে মূল স্থলভূমিতে আনতে হয়। তাতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর পরে আবার ছুট। জয়নগর, বারুইপুর কিংবা ক্যানিংয়ের সরকারি হাসপাতালে। সেখানে কাজ না হলে কলকাতায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয় যাত্রাপথেই। বন্যপ্রাণীর আক্রমণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় বলেই আক্রান্তের চিকিৎসায় ট্রমা কেয়ার প্রয়োজন। কিন্তু এখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রামীণ বা মহকুমা হাসপাতাল, কোথাওই সেই চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই বলে জানা গিয়েছে। যে কারণে, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর পরিজন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে নির্ভর না করে তাঁকে নিয়ে সরাসরি কলকাতায় চলে যান।
সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি গোসাবার ছোট মোল্লাখালির শ্যামাপদ শীলের। দুই সঙ্গী ও বন দফতরের পাস নিয়ে বসিরহাট রেঞ্জের বড় হরিখালি খালে কাঁকড়া ধরতে গিয়েছিলেন তেতাল্লিশ বছরের শ্যামাপদ। গত ২১ তারিখে কাঁকড়া ধরার সময় শ্যামাপদর উপরে বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কোমর, বুকে, পিঠে ভয়ঙ্কর ক্ষত হলেও বাঘে নিতে পারেনি তাঁকে। দুই সঙ্গী বৈঠা নিয়ে তেড়ে গেলে বাঘ শিকার ছেড়ে জঙ্গলে পালায়। রক্তাক্ত শ্যামাপদকে নিয়ে তিন ঘণ্টা নৌকা বেয়ে ডাঙায় আসেন সঙ্গীরা। এখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক (সিএমওএইচ) মুক্তিসাধন মাইতি জানালেন, তাঁদের গোটা জেলায় অ্যাডভান্সড লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে দু’টি। তবে সাধারণ রোগীদের জন্য ‘নিশ্চয় যান’ কিংবা ১০২ অ্যাম্বুল্যান্সই ব্যবহার করা হয়। গ্রামের খবর, নিশ্চয় যানেরও সরকারি হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাগে। তাতে বহু ক্ষেত্রে রোগীর জীবন সঙ্কটে পড়ে যায়। প্রাণে বেঁচে গিয়ে খানিকটা সুস্থ হওয়া রোগীদের আবার একই ভাবে দূরের পথ পেরিয়ে হত্যে দিতে হয় কলকাতার হাসপাতালে, পরবর্তী পর্যায়ের চিকিৎসার জন্য। বাঘের আক্রমণে হওয়া গালের ক্ষত সারাতে কৈখালি আশ্রমের হরিপদ দাস, চোখ নষ্ট হওয়া দেবীপুরের গণেশ শ্যামলরা বার বার এসএসকেএমে চক্করকেটে চলেন।
স্থানীয়দের মতো মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এরও অভিযোগ যে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার চিকিৎসাক্ষেত্রে বাঘ-কুমিরের আক্রমণের ঘটনাকে আলাদা কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্তই ঠিক মতো করা হয় না। এপিডিআর-এর গোসাবা শাখার সম্পাদক সর্বরঞ্জন মণ্ডলের তির্যক মন্তব্য, ‘‘আমরা এখানকার বাসিন্দা। আমাদের জীবনটাই একটা শাস্তির মতো। এখানে সরকারি আধিকারিকেরাও শাস্তিমূলক পোস্টিংয়ে আসেন। ফলে এই সব জায়গার উন্নতির জন্য তেমন কোনও প্রচেষ্টা বন দফতর, স্বাস্থ্য দফতর কিংবা সরকারের নেই। রাস্তা ভাঙাচোরা, সাধারণ মানের অ্যাম্বুল্যান্স, দুর্বল গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত রোগীকে মোটরচালিত ভ্যানে চাপিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতেই হাসপাতালে পৌঁছতে হয়।’’
অবশ্য সর্বরঞ্জন জানালেন যে, ২০০৭ সালে একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, যাতে এখানকার মানুষকে রোজগারের জন্য নদী-জঙ্গলের উপরে নির্ভর করতে না হয়। তিনি জানান, সেই সময়ে গ্রামবাসীদের গ্রামের উপরে নির্ভরশীল করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। অনেকে চাষবাস, মুরগি, শুয়োর পালন— এ সব থেকে রোজগার করা শুরু করেন। কিন্তু ২০০৯ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই সব খামার, চাষের জমি নষ্ট হয়ে যায়। তার পরে এখানকার মানুষ আবার শুধুই জঙ্গল-নির্ভর হয়ে পড়েন বলে জানাচ্ছেন সর্বরঞ্জন।
বর্তমানে রাজ্য সরকারের তরফে সুন্দরবনের উন্নয়নের জন্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাজ্যের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ দফতর ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে একযোগে কাজ করছে। বিশ্বব্যাঙ্কের টাকা পেতে প্রকল্পের রিপোর্ট অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের কাছে পাঠানোর কথাও ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। মানুষকে নদী-জঙ্গলের থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের জন্য গ্রামের উপরে নির্ভরশীল বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থা করা, উন্নত পরিবহণ ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিতওই প্রকল্পে।
সেই সব প্রকল্প কত দিনে বাস্তবায়িত হবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। নোনাজলে ভাসতে থাকা হরিপদ, গণেশ, শ্যামাপদদের এই জঙ্গল-জীবনে কোনও কাব্যের ঠাঁই নেই।
(শেষ)