West Bengal School Recruitment Case

রাজ্য সরকার ঘোষিত ভাতায় কেন অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিলেন বিচারপতি সিংহ? কী বললেন পর্যবেক্ষণে?

রাজ্যের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। সেখানে মামলা বিচারাধীন। এই অবস্থায় আপাতত ওই কর্মীদের ভাতা দেওয়া হোক। কিন্তু বিচারপতি সিংহ তাতে সায় দেননি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ ২০:৫৬
Why an interim stay order given by Justice Amrita Sinha of Calcutta High Court over allowance of group C and D employees

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আদালতের রায়ের ফলে চাকরিহারা গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীদের প্রতি মাসে ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য।কিন্তু শুক্রবার রাজ্যের সেই সিদ্ধান্তে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিংহ। তিনি জানিয়েছেন, ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বা আদালত যতদিন না পরবর্তী নির্দেশ দিচ্ছে ততদিন ভাতা দিতে পারবে না রাজ্য। আদালত জানিয়েছে, চার সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যকে হলফনামা জমা দিতে হবে। তার ১৫ দিনের মধ্যে পাল্টা হলফনামা দেবেন মামলাকারীরা।

Advertisement

হাই কোর্টের এই রায়ে রাজ্য সরকার এবং শাসকদল ধাক্কা খেল বলেই মনে করছেন অনেকে। গত ১৫ মে রাজ্যের শ্রম দফতর বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, চাকরিহারা গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি কর্মীদের মানবিক কারণে ভাতা দেওয়া হবে। তাঁদের পরিবারের কথা ভেবেই ওই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী গত ১ এপ্রিল থেকে গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি কর্মীদের যথাক্রমে ২৫ হাজার এবং ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া শুরু হয়।

রাজ্যের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। সেখানে মামলা বিচারাধীন। এই অবস্থায় আপাতত ওই কর্মীদের ভাতা দেওয়া হোক। কাদের ভাতা দেওয়া হবে তা চিহ্নিত করার জন্য একটি স্ক্রিনিং কমিটি গঠন করা হয়। বিচারপতি সিংহ তাঁর পর্যবেক্ষণে প্রশ্ন তুলেছেন, আদালতের নির্দেশে বাতিল হওয়া অশিক্ষক কর্মচারীদের কী ভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে রাজ্য? তিনি বলেন, ‘‘কোর্ট বেতন ফেরতের নির্দেশ দিয়েছে। আর রাজ্য তাঁদের ভাতা দিচ্ছে। এই সুবিধা দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই। রাজ্যের পদক্ষেপ আদালতের নির্দেশ অমান্য করছে। এমন আর্থিক প্রকল্প বাতিল হওয়া উচিত।’’

মামলাকারীদের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুদীপ্ত দাশগুপ্ত, ফিরদৌস শামিম, বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গোপা বিশ্বাস। তাঁদের বক্তব্য, জনসাধারণের করের টাকা এ ভাবে খরচ করা যায় না। আদালতের নির্দেশের বাইরে গিয়ে কোনও প্রকল্প করা উচিত নয় রাজ্যের। রাজ্যের ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংবিধানের ১৪, ১৬, ২১, ১৪৪, ১৬২ ও ২৮২ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। তাঁরা উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালে একটি রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আইনসভা সাংবিধানিক আদালতের রায় বাতিল করতে পারে না।

অন্য দিকে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) কিশোর দত্তের সওয়াল, এটা কোনও জনস্বার্থ মামলা নয়। তাঁরা অপেক্ষমাণ তালিকায় (ওয়েটিং লিস্ট) ছিলেন এবং আদালতের রায় তাঁদের পক্ষে যায়নি। তাই বঞ্চিত প্রার্থীদের এই মামলা করার অধিকার নেই। এ ছাড়া এই মামলায় কোনও চাকরিহারাকে যুক্ত করা হয়নি। এজি জানান, এই প্রকল্প অস্থায়ী এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রিভিউ পিটিশনের উপর নির্ভর করবে। ফলে এখন মামলার কোনও কারণ নেই। এজির যুক্তি, রাজ্য নিজস্ব আইনি ক্ষমতায় ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার মানুষের জীবিকা রক্ষা হবে। রাজ্যের আইনি যুক্তি, রিভিউ পিটিশন বিচারাধীন থাকাকালীন হাই কোর্টের এই মামলা শোনা উচিত নয়। এই মর্মে শীর্ষ আদালতের একাধিক রায় রয়েছে। তাই এই মামলা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। বিচারপতি সিংহ জানান, মামলাটি এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আদালত দু’পক্ষের বক্তব্য শুনতে চায়। তবে আপাতত এই মামলায় অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়া হবে।

বিচারপতি সিংহের পর্যবেক্ষণ, মামলাকারীরাও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা অপেক্ষামাণ তালিকায় ছিলেন কিন্তু নিয়োগ পাননি। আর যাঁদের ভাতা দেওয়া হয়েছে তাঁরা চাকরি পাওয়ার পর চাকরি হারিয়েছেন। অর্থাৎ, বর্তমান পরিস্থিতিতে উভয়েই বেকার। অতএব, প্রকল্পে এক অংশ বেকারকে সুবিধা দিয়ে অন্য অংশকে বঞ্চিত করা বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ। রাজ্যের উচিত সকলকে প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। সংবিধানের ২১ ও ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবার সমান সুবিধা পাওয়া উচিত। অন্য দিকে, কেউ যদি বঞ্চিত হন সে ব্যক্তিগত ভাবে মামলা করতেই পারেন। এর জন্য জনস্বার্থ মামলা করার প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁর আরও পর্যবেক্ষণ, “দু’পক্ষই যেখানে ক্ষুদার্থ, সেখানে রাষ্ট্র এক পক্ষকে খাবার তুলে দিয়ে, অন্য পক্ষকে বঞ্চিত করতে পারে না।’’

আদালত জানায়, মামলাকারীদের সঙ্গে ভাতা পাওয়া চাকরিহারাদের তুলনা ঠিক নয় বলে জানিয়েছে রাজ্য। আর সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ওই নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি করে কেউ চাকরি পেলে তাঁকে কি রাজ্যের কোষাগার থেকে টাকা দেওয়া যায়? দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কাজ না করেও টাকা পাবেন। ভবিষ্যতে এই টাকা আর ফেরত নেওয়া যাবে না। ফলত, অন্যায় করেও কিছু লোকের পকেটে টাকা যাবে। যদি আদালত ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তে অন্তর্বতী স্থগিতাদেশ দেয় তবে চাকরিহারাদের মৌলিক অধিকার খর্ব হবে না। তা ছাড়া সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাজের সুযোগ তৈরি করা। কাজ না করলেও টাকা দেওয়া নয়। রিভিউ পিটিশন বিচারাধীন এই যুক্তিতে রাজ্য ভাতা দিতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে আসুক। বিচারপতি সিংহ তাঁর নির্দেশে জানান, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে রাজ্যকে হলফনামা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তারা চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা জমা দেবে। পরবর্তী দু'সপ্তাহের মধ্যে পাল্টা হলফনামা দেবেন মামলাকারীরা। এমতাবস্থায় ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।

Advertisement
আরও পড়ুন