Bangaldesh Unstable Situation

হিংসার দায় হাসিনার কাঁধে চাপালেন ইউনূস, নিশানায় ভারতও! অশান্ত বাংলাদেশে সুষ্ঠু ভোটের বার্তা কমিশনের

দিল্লি এবং শিলিগুড়ির পরে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে মঙ্গলবার আগরতলায়ও ভিসা-কেন্দ্র সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:৩৭
(বাঁ দিকে) বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের

(বাঁ দিকে) বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।

বাংলাদেশে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মুখ ওসমান হাদির খুনের পর থেকে ফের উত্তাল হয়েছে ঢাকা-সহ বিভিন্ন এলাকা। ভাঙচুর, তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ— সবই হয়েছে। বাদ যায়নি ছায়ানট, উদীচীর মতো ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি সংবাদপত্রের দফতরও। এরই মধ্যে শরীয়তপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে মঙ্গলবার বলেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থকেরা বাংলাদেশে ভোট বিঘ্নিত করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালছে!

Advertisement

দিল্লি এবং শিলিগুড়ির পরে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে মঙ্গলবার আগরতলায়ও ভিসা-কেন্দ্র সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ১০ দিনের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে বলে সূত্রের খবর। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের দাবি, তাদের রাষ্ট্রদূতকে মঙ্গলবার বিকেলে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে তলব করে। অন্য দিকে, মঙ্গলবার রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে বাংলাদেশে দীপুচন্দ্র দাস নামে এক যুবককে খুনের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে‌। এরই মধ্যে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অবাধ এবং সুষ্ঠু ভোটের লক্ষ্যে বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসিরউদ্দিন পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং আঞ্চলিক নির্বাচন আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মঙ্গলবার।

ইউনূসের অভিযোগ

শেখ হাসিনার সমর্থকেরা বাংলাদেশের নির্বাচনকে বিঘ্নিত করতে লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালছেন। এমনটাই দাবি করলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ায় আমেরিকার বিশেষ দূত সার্জিও গোরের সঙ্গে ফোনে কথা হয় ইউনূসের। গোর ভারতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসাবেও নিযুক্ত রয়েছেন। ওই ফোনালাপের সময়েই বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে এই দাবি করেন ইউনূস।

আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন। সেদিনই হবে জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট। তবে গত কয়েক দিন ধরে যে ভাবে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে বাংলাদেশে, তাতে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজ়ান্ডার গ্রিগোরাইভিচও চাইছেন, নির্বাচনের আগে শান্তি ফিরুক বাংলাদেশে। মঙ্গলবার ইউনূস দাবি করেছেন, নির্ধারিত সময়েই সে দেশে নির্বাচন হবে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, “দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। স্বৈরাচারী শাসনকালে তা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।”

গোরের সঙ্গে সোমবার রাতে প্রায় আধ ঘণ্টা ফোনে কথাবার্তা হয় ইউনূসের। এমনটাই দাবি করেছে সে দেশের সরকারি সংবাদসংস্থা ‘বাসস’। ওই ফোনালাপের সময়েই ইউনূস বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শাসনের সমর্থকেরা নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। তাদের পলাতক নেতা হিংসা উস্কে দিচ্ছেন।” তাঁর দাবি, অন্তর্বর্তী সরকার যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে। সরাসরি কারও নাম না নিলেও ‘ক্ষমতাচ্যুত শাসন’ বলে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন ইউনূস।

জানা যাচ্ছে, গোরের সঙ্গে ইউনূসের ফোনালাপের মুখ্য বিষয় ছিল আমেরিকা এবং বাংলাদেশের বাণিজ্য ও শুল্কের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি সে দেশের আসন্ন নির্বাচন এবং সম্প্রতি ওসমান হাদির হত্যার প্রসঙ্গও উঠে আসে আলোচনায়। নির্বাচন ঘোষণার পরই বাংলাদেশে বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ ওসমান হাদি। তাঁর মৃত্যুর পর গত বৃহস্পতিবার থেকে ফের উত্তাল হয়েছে বাংলাদেশ। চলেছে ভাঙচুর, তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ। বাংলাদেশের বিভিন্ন নেতাদের মুখে ভারতবিরোধী বক্তৃতাও শোনা গিয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাস কর্তৃপক্ষও। ভোটের আগে অশান্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তাঁরা। এ অবস্থায় ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ইউনূসের এই বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

পুলিশকে নির্দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের

নির্বাচন এগিয়ে আসতেই আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সোমবার রাতে সংঘর্ষ এবং ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ উঠে এসেছে ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুরে। মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিংসার খবর এসেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। যে কোনও মূল্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই বার্তা প্রতিফলিত হয়েছে ঢাকা মহানগরের পুলিশপ্রধানের বার্তাতেও।

সোমবারই খুলনায় গুলিবিদ্ধ হন হাসিনাবিরোধী রাজনীতি থেকে উঠে আসা নতুন দল এনসিপি-র শ্রমিক নেতা মোতালেব শিকদার। কয়েক দিন আগে অপর এক হাসিনাবিরোধী সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা হাদিকে খুন করা হয়। জানা যাচ্ছে, এই দুই ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার বিক্ষোভ মিছিল করছিল এনসিপি। সেই সময়েই ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় তারা। দু’দলের সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণেরও অভিযোগ উঠেছে। জখম হয়েছেন অন্তত আট জন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মুহাম্মদ সাজ্জাত আলি সোমবার রাজধানীর ৫০টি থানার ওসিদের নিয়ে বৈঠক সারেন। জানা যাচ্ছে, ওই বৈঠকেই উঠে এসেছে, নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। নির্বাচনের আগে নাশকতা, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা পুলিশের আধিকারিকেরা। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনে যাতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে পুলিশের বৈঠকে।

এ বার বন্ধ আগরতলায়‌ ভিসা কেন্দ্র

প্রথমে দিল্লি, তার পরে শিলিগুড়ি, এ বার আগরতলায়ও ভিসা-কেন্দ্র সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিল বাংলাদেশ। মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ আগরতলার ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে তারা। বন্ধ রাখা হচ্ছে অন্য কনসুলার পরিষেবাও। কী কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা দিল্লি বা শিলিগুড়ির মতো এ ক্ষেত্রেও স্পষ্ট করেনি ঢাকা। যদিও কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশন থেকে পরিষেবায় কোনও বিঘ্ন ঘটেনি।

সোমবার রাতে এক সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞপ্তিতে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন জানিয়েছে, অনিবার্য কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না-হওয়া পর্যন্ত আগরতলায় ভিসা এবং কনসুলার পরিষেবা বন্ধ থাকবে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে তারা। এর আগে সোমবার নয়াদিল্লি এবং শিলিগুড়িতেও ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। এ বার আগরতলায়ও ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ করে দিল ঢাকা। রাতারাতি সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশের তিনটি ভিসা পরিষেবা কেন্দ্র। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন আগে থেকেই চলছিল। এ বার সেই টানাপড়েনে ভিসা-কেন্দ্রের সমীকরণও জুড়ে গেল।

সম্প্রতি ঢাকায় ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নয়াদিল্লি। তার পরে আরও দুই শহর রাজশাহী এবং খুলনাতেও ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে ভারতীয় ভিসা-কেন্দ্রও। তবে ভারতের এই পদক্ষেপগুলির নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। সম্প্রতি ভারতের কূটনৈতিক দফতরের সামনে বিক্ষোভ হয় বাংলাদেশে। প্রথমে নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ঢাকায় ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় নয়াদিল্লি। পরে বাংলাদেশের ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর পরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা। ওই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ভারতের ডেপুটি হাইকমিশন ঘেরাওয়ের ডাক দেয় সে দেশের একটি গোষ্ঠী।

ওই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মাঝেই চট্টগ্রামে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের দফতর লক্ষ্য করে ইট ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। বিক্ষোভকারীদের হটাতে লাঠি চালায় এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। উত্তেজনা ছড়ায় সিলেটেও। তার পরেই রবিবার চট্টগ্রামের ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিলেটে ভারতের উপদূতাবাসের কাছেও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে, রবি এবং সোমবারের পরে মঙ্গলবারেও দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যমে তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ নয়াদিল্লির। তার বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, বিক্ষোভ হলেও বিক্ষোভকারীরা কেউই বাংলাদেশের কূটনৈতিক দফতরের ভিতরে প্রবেশ করেননি। তবে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক টানাপড়েন জিইয়ে রাখার চেষ্টা দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের। অন্য দিকে, ভারত সরকার ওই ঘটনাকে ‘সরলীকরণ’ করার চেষ্টা করছে বলে দাবি করে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।

ঘটনাচক্রে, রবিবার বাংলাদেশের ওই বিবৃতির পরের দিনই দেখা যা। দিল্লিতে ভিসা-কেন্দ্র অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকমিশন। তার কিছু সময় পরে জানা যায় শিলিগুড়িতেও ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বস্তুত, শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের কোনও ঘোষিত কূটনৈতিক দফতরও নেই। বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে সেখানে ভিসা-কেন্দ্র পরিচালনা করে বাংলাদেশ। কী কারণে সেখানে ভিসা পরিষেবা কেন্দ্র বাংলাদেশ বন্ধ করেছে, তা-ও সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। সোমবার শিলিগুড়িতে ভিসা-কেন্দ্রের কাছে বিক্ষোভ দেখায় একদল বিক্ষোভকারী। ময়মনসিংহে দীপুচন্দ্র দাসের হত্যার প্রতিবাদেই ওই বিক্ষোভ হয়। ঘটনাচক্রে, ওই কর্মসূচির পরেই শিলিগুড়িতে ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ। শিলিগুড়িতে সোমবারের বিক্ষোভ কর্মসূচির অন্যতম মুখ লক্ষ্মণ বনসল বলেন, “আমাদের এখানকার কর্মীদের সঙ্গে কোনও সমস্যা নেই৷ পুলিশ বাধা দিলেও সেই বাধা আমরা মানিনি। এই অফিসের আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে এই কেন্দ্র বন্ধ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

রাষ্ট্রদূতকে তলব এবং পাল্টা তলব

ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় বর্মাকে ফের ডেকে পাঠাল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। বিকেলে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক তলব করে বলে সে দেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো জানিয়েছে। এই নিয়ে গত ১০ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার দু’দেশ রাষ্ট্রদুতকে তলব-পাল্টা তলব করল। এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর এমনটাই হয়েছিল।

কী কারণে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ফের ডেকে পাঠানো হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে গত কয়েক দিনে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বাংলাদেশে বেশ কিছু ভিসা-কেন্দ্র সম্প্রতি বন্ধ রাখে ভারত। সোমবার এক রাতের মধ্যে ভারতে তিনটি ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশও। ঠিক তার পরের দিন সকালেই ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ঢাকার বিদেশ মন্ত্রকে ডেকে পাঠানোয়, ঘটনার গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু নেতার ভারতবিরোধী মন্তব্য, ভারতের কূটনৈতিক দফতরে অভিযানের ফলে ভারতীয় হাইকমিশন এবং উপহাইকমিশনগুলির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দানা বাঁধে। তার পরে বাংলাদেশের তরুণ নেতা ওসমান হাদির মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নিরাপত্তাজনিত কারণেই ভিসা-কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। উদ্ভূত এই পরিস্থিতির মাঝে ময়মনসিংহে সংখ্যালঘু যুবক হত্যার প্রতিবাদে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের কাছে বিক্ষোভ হয়। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে ঢাকাও।

দীপু-হত্যা নিয়েও এ বার মুখ খুলল রাষ্ট্রপুঞ্জ

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। এ বার সেই একই উদ্বেগ রাষ্ট্রপুঞ্জেরও। সোমবার ফের বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছে এই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে তারা খুবই উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি বাংলাদেশের ময়মনসিংহে দীপুচন্দ্র দাসকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছে। পরে তাঁর দেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় ইতিমধ্যে ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছে ভারত। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সে দেশের সংখ্যালঘুদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েও। সোমবার রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজ়ারিককে প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে। গত কয়েক দিনে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনায় মহাসচিবের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়।

ওই প্রশ্নের উত্তরে গুতেরেসের মুখপাত্র বলেন, “হ্যাঁ, বাংলাদেশে যে হিংসা আমরা দেখেছি, তাতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশেই হোক, বা অন্য কোনও দেশে— যাঁরা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সম্প্রদায়ের নন, তাঁদেরও নিরাপদ বোধ করা উচিত। প্রত্যেক বাংলাদেশিরই নিরাপদ বোধ করা উচিত। আমরা বিশ্বাস করি (অন্তর্বর্তী) সরকার প্রত্যেক বাংলাদেশিকে নিরাপদে রাখতে সাধ্যমতো সব পদক্ষেপ করবে।” ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করেছে, ময়মনসিংহের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ভারতের কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বলে দেখাচ্ছেন বলে দাবি করেছে তারা। বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের দাবি, বাংলাদেশে একজন নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ইউনূসদের দাবি, ময়মনসিংহের ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ করা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। তবে এ সবের মধ্যেই এ বার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল রাষ্ট্রপুঞ্জও।

সাম্প্রতিক সময়ে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলল রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর আগে মুখ খুলেছিল বাংলাদেশের তরুণ নেতা ওসমান হাদির খুনের ঘটনায়। গত শনিবার এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছিল, হাদির হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশকে সংযত হতে হবে। গুতেরেস বলেছিলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে’’। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে তদন্তপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও মনে করেন গুতেরেস। এমনটাই জানিয়েছিলন তাঁর মুখপাত্র।

সুষ্ঠু ভোটের লক্ষ্যে বৈঠকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশে দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে। রক্ত ঝরেছে। সেই আবহে সুষ্ঠু ভাবে ভোট পরিচালনা করানো নিয়ে ‘চাপ’ রয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের। অনেকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছে কমিশনের উপর। এ বার সেই অপবাদ ঘোচাতে চায় কমিশন। মঙ্গলবার বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের জানান, প্রমাণ করতে চান, তাঁরাও সঠিক এবং সুন্দর ভোট করাতে পারেন!

আগামী বছর বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন রয়েছে। ১২ ফেব্রুয়ারি হবে ভোটগ্রহণ। তবে গত কয়েক দিন ধরে যে ভাবে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে বাংলাদেশে, তাতে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সেই বিষয় উল্লেখ করেন বাংলাদেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এমএম নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘‘নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য কমিশনকে সামগ্রিক ভাবে দায়ী করা হচ্ছে। তবে আমরা এই অপবাদ থেকে মুক্তি চাই। প্রমাণ করতে চাই, আমরাও সুষ্ঠু এবং সুন্দর নির্বাচন করাতে পারি। তবে এটা একমাত্র আইনের শাসনের মাধ্যমে সম্ভব।’’

নির্বাচন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মঙ্গলবার ঢাকার নির্বাচন ভবনে পুলিশ কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং আঞ্চলিক নির্বাচন আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন সিইসি। বাংলাদেশের সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ সূত্রে খবর, ওই বৈঠকে নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করতে প্রশাসনের কর্তাদের আইনের শাসন নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রশাসন এবং পুলিশ কর্তাদের উদ্দেশে বৈঠকে সিইসি বলেন, ‘‘আপনারা দেশের অবস্থা জানেন। এই অবস্থায় আমাদের উপরে যে দায়িত্ব এসে পড়েছে, সেই আবহে আমরা যদি সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জবাব দিতে পারব না।’’

কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ

বাংলাদেশে দীপু দাসের খুনের ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল কলকাতাও। কলকাতার বেকবাগানে বাংলাদেশের উপদূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। পুলিশে সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। প্রতিবাদ কর্মসূচির কারণে ওই এলাকায় সাময়িক যানজটের সৃষ্টি হয়।

সম্প্রতি ময়মনসিংহে দীপু দাসকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনার প্রতিবাদ শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। মঙ্গলবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, এভিবিপি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ-সহ সঙ্ঘ পরিবারের একাধিক সংগঠনের ডাকে বাংলাদেশের উপদূতাবাস অভিযানে জড়ো হন অনেকে। মিছিল করে তাঁরা পৌঁছোন বেকবাগান এলাকায়। তবে বাংলাদেশের উপদূতাবাসের সামনে পৌঁছোনোর আগেই বিক্ষোভকারীদের আটকে দেয় পুলিশ।

বিক্ষোভকারীদের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ উপদূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের আটকাতেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বেকবাগান এলাকা। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জও করে পুলিশ। অভিযোগ, পুলিশের লাঠির ঘায়ে কয়েক জন আহত হয়েছেন। পরে বিক্ষোভকারীদের অনেককে টেনেহিঁচ়ড়ে প্রিজ়ন ভ্যানে তোলা হয়। অনেক বিক্ষোভকারীকে দেখা যায়, প্রিজ়ন ভ্যানের ছাদের উপর উঠে পড়তেও।

বেকবাগান তপ্ত হয়ে ওঠায় বিজেপি নেতৃত্বও ঘটনাস্থলে পৌঁছোন। ঘটনাস্থলে যান উত্তর কলকাতা জেলা বিজেপির সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ। তাঁর দাবি, পুলিশের লাঠি চালানোর প্রতিবাদ জানাতে এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির পাশে দাঁড়াতে গিয়েছেন তাঁরা।বেশ কিছু ক্ষণ ওই এলাকায় উত্তেজনা ছিল। পুলিশের তরফে বার বার ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশের উপদূতাবাসের বাইরে জমায়েত বেআইনি। ব্যারিকেড থেকে দূরে সরে যাওয়ার অনুরোধও করে পুলিশ। তবে বিক্ষোভকারীরা জানান, যত ক্ষণ না তাঁরা উপদূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দিচ্ছেন, তত ক্ষণ বিক্ষোভ-অবস্থান চলবে। বিক্ষোভের কারণে পার্ক সার্কাসের একাংশে যানজট তৈরি হয়।

কলকাতার পাশাপাশি দিল্লিতেও ভিএইচপি এবং বজরং দলের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায়। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হাইকমিশনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ। জমায়েত ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবাদ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সকাল থেকে চাপা উত্তেজনা ছিল দিল্লিতে। সেখানকার বাংলাদেশের হাইকমিশনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা হয় হাইকমিশন চত্বর। দিকে দিকে বসানো হয় পুলিশ ব্যারিকেড। মোতায়েন অতিরিক্ত বাহিনীও। তবে বেলা গড়াতেই উত্তেজনা ছড়ায় হাইকমিশনের বাইরে।

Advertisement
আরও পড়ুন