—প্রতীকী চিত্র।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক দীপুচন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে খুন করে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় উন্মত্ত জনতার পাশাপাশি, পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়ল। একই সঙ্গে এই ঘটনার তদন্তে নামা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) পুলিশকে আড়াল করতে সচেষ্ট বলেও অভিযোগ উঠছে। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়ো (যার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার) তুলে ধরে লেখিকা তসলিমা নাসরিন-সহ অনেকেই অভিযোগ করেছেন, দীপুকে সে দিন পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল। পরে তাঁকে জনতার হাতে পুলিশই তুলে দিয়েছে।
ময়মনসিংহের পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কোম্পানির শ্রমিক দীপুকে খুনের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-ও এই খুনের তদন্তে নেমেছে। গ্রেফতারির বিবরণ দিতে গিয়ে র্যাব-এর কর্তাদের দাবি, দীপুকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করার পরে পোশাক কারখানার ফ্লোর ম্যানেজার তাকে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দেয়। র্যাব-এর কর্তা নাইমুল হাসান বলেন, “ঘটনার সূত্রপাত ৪টার সময়ে। ফ্যাক্টরির ফ্লোর ইনচার্জ তাঁকে (দীপুকে) ইস্তফা দিতে বাধ্য করে। ইস্তফা দেওয়ার পরে উত্তেজিত জনতার কাছে তাঁকে তুলে দেয়। পুলিশের কাছে কেন দেয়নি, তার নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করেনি, সে জন্য পাইওনিয়ার কারখানার দু’জনকে গ্রেফতার করেছি।’’ এঁরা হলেন, ফ্লোর ম্যানেজার আলমগীর হোসেন (৩৮) এবং কারখানার কোয়ালিটি ইনচার্জ মিরাজ হোসেন আকন (৪৬)। ময়মনসিংহ র্যাব-এর কোম্পানি কমান্ডার মোহম্মদ সামসুজ্জামান এই ঘটনায় ‘ধর্ম অবমাননার’ কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘নিহত ব্যক্তি যদি ফেসবুকে কিছু লিখতেন, তা হলেও একটা বিষয় হত। সেখানে সবাই এখন বলছেন, তারা তাঁকে এমন কিছু বলতে নিজেরা শোনেননি। কেউ নিজে শুনেছেন বা দেখেছেন (ধর্ম অবমাননার বিষয়ে), এমন কাউকেও পাওয়া যায়নি।’’
র্যাব-এর কর্তারা এমন দাবি করলেও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, থানার মধ্যে একটি বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে দীপুকে। এই ভিডিয়ো নিজের ফেসবুকে পোস্ট করে লেখিকা তসলিমা লিখেছেন, ‘শুনেছি কারখানায় দীপুর পদোন্নতি হয়েছিল। যে মুসলমান সহকর্মীর পদোন্নতি হয়নি, সে ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে এক ভিড় লোকের মধ্যে দীপুকে ঠেলে দিয়ে ঘোষণা করে দিল, দীপু ইসলামের নবী সম্পর্কে কটূক্তি করেছে’। তসলিমা লিখেছেন, ‘পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিল, নাকি তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিল, জানি না, তবে এটা ঠিক, দীপু ছিল পুলিশের হেফাজতে। এই ভিডিয়োটিই তার প্রমাণ’। এক নেট-নাগরিকের কথায়, ‘যে পুলিশ এক জন দীপু দাসের দায়িত্ব নিতে পারে না, সেই পুলিশ কি করে একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেবে? বাংলাদেশ কি আসলেই জঙ্গির কবলে’?
দীপু দাসকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সরাসরি ইউনূস সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “এই সব ঘটনা প্রমাণ করে যে, পুরনো একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিত ভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তারা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের একটি নতুন সংস্করণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।”
তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়া কান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে দীপুর দেড় বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। দীপুর বাবা রবিচন্দ্র দাস জানান, সরকার কোনও আশ্বাস দেয়নি, কেউ যোগাযোগ করেনি। তাঁরা ছেলের মৃত্যুর খবর প্রথম দেখতে পান ফেসবুকে। এক আত্মীয় এসে জানান, তাঁর ছেলের মরদেহ গাছে বেঁধে কেরোসিন ঢালা হচ্ছে! পুলিশ ১০ জনকে গ্রেফতার করলেও আতঙ্কে সিঁটিয়ে পরিবার। র্যাবের তরফে জানানো হয়েছে, মামলা থানাই তদন্ত করবে। র্যাব-এর ‘ছায়া-তদন্ত’ চলবে বলেও জানিয়েছেন কর্তারা।