‘ক্যাঙারু-রাষ্ট্রে’র দুয়ারে বিপদ! চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে ড্রাগন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর ‘দৌরাত্ম্যে’ ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে দক্ষিণ গোলার্ধের সমগ্র ‘দ্বীপ-মহাদেশ’। সম্প্রতি, সামুরাই-যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় চিন, যার জেরে তৈরি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই এ বার ক্যাঙারুভূমিকে নিশানা করল ড্রাগনের নৌবাহিনী। ফলে দূর প্রাচ্য ও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার পরিস্থিতি যে ক্রমশ জটিল হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উপগ্রহভিত্তিক ছবি প্রকাশ্যে এনে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনকে (পড়ুন পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না) নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সতর্ক করে ‘ভ্যান্টর’ নামের যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের দাবি, বেপরোয়া ভাবে ফিলিপিন্স সাগরের মধ্য দিয়ে ‘ক্যাঙারু রাষ্ট্র’-এর উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা। ড্রাগনের এ-হেন ‘আগ্রাসন’কে ক্যানবেরার জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেছে আমেরিকার ওই গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২ ডিসেম্বর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অস্ট্রেলিয়ার দিকে এগোতে থাকে ফিলিপিন্স সাগরে মোতায়েন চিনা নৌবহর। ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহ সেই ছবি পাঠাতেই নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ‘ভ্যান্টর’। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, দু’টি রণতরী এবং সামরিক হেলিকপ্টার বহনকারী যুদ্ধজাহাজ সহযোগে ‘শিকারি বেড়ালের’ মতো ধীরে পায়ে ‘ক্যাঙারু রাষ্ট্র’-এর দিকে এগিয়েছে পিএলএ নৌবাহিনী। জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতে একটি তেলবাহী জাহাজও সঙ্গে রয়েছে তাদের।
আমেরিকার থেকে চৈনিক ‘আগ্রাসনের’ খবর পেয়ে সতর্ক হয় অস্ট্রেলিয়া। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন ক্যানবেরার প্রতিরক্ষা প্রধান অ্যাডমিরাল ডেভিড জনস্টন। পিএলএ-র ওই নৌবহরে চারটি রণতরী রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি, যার মধ্যে একটি রেনহাই শ্রেণির ক্রুজ়ার। এ ছাড়া রয়েছে জিয়াংকাই শ্রেণির একটি ফ্রিগেটও। প্রথমটি প্রকৃতপক্ষে টাইপ ০৫৫র ডেস্ট্রয়ার এবং দ্বিতীয়টি একটি টাইপ ০৫৪এ ফ্রিগেট। এই দুই যুদ্ধজাহাজ গাইডেড-ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সক্ষম বলে জানা গিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার জলসীমা সংলগ্ন এলাকায় চৈনিক রণতরীর উপস্থিতির খবর পেয়েই পি-৮ নজরদারি বিমান পাঠান অ্যাডমিরাল জনস্টন। তাঁর কথায়, ‘‘২ ডিসেম্বর প্রায় ৫০০ নটিক্যাল মাইল উত্তরে ফিলিপিন্স সাগরে পৌঁছে কয়েক ঘণ্টা চক্কর কাটে আমাদের সামরিক উড়োজাহাজ। ফলে পিএলএ যুদ্ধজাহাজ কখন, কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে, তা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ওই এলাকায় নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে ড্রাগন, যা অবশ্যই উদ্বেগের।’’
এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছেন অসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেসও। তিনি বলেন, ‘‘নভেম্বর শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনে উত্তর ফিলিপিন্স সাগরে বেশ কয়েক বার যুদ্ধের মহড়া চালিয়েছে পিএলএ নৌবাহিনী। তাদের গতিবিধি নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কারণ, জায়গাটা অস্ট্রেলিয়ার জলসীমার খুবই কাছে।’’ বেজিঙের এ-হেন ‘আগ্রাসী’ মনোভাবকে রণহুঙ্কার বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
মার্লেস জানিয়েছেন, অসি নৌসেনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়া, উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ ভাগের সংবেদনশীল এলাকাগুলির উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছে। তবে এখনও পর্যন্ত ক্যানবেরার জলসীমা টপকে ভিতরে ঢুকে আসেনি চিনা রণতরী। ফলে পিএলএ নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ করা যে বেশ কঠিন, তা মানছেন ‘ক্যাঙারু রাষ্ট্র’-এর প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
‘ভ্যান্টর’-এর উপগ্রহভিত্তিক ছবিগুলি পরীক্ষার পর সংবাদসংস্থা বিবিসির কাছে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন প্রবীণ মার্কিন নৌবিশ্লেষক মাইক প্লাঙ্কেট। তাঁর কথায়, ‘‘পিএলএ-র নৌবহরে একটি টাইপ ০৭৫ হেলিকপ্টার অবতরণকারী যুদ্ধপোত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট রণতরীটিতে মোতায়েন আছে অন্তত ৩০টি হামলাকারী সামরিক কপ্টার। এ ছাড়াও থাকতে পারে হাজারের বেশি মেরিন কমান্ডো। ফলে ঝটিতি হামলায় অসি উপকূলের কিছুটা দখল করা তাদের পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়।’’
প্লাঙ্কেট জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট নৌবহরে ১১ হাজার টন জ্বালানিবাহক একটি জাহাজ রয়েছে। এই ধরনের সামরিক জলযানে কয়েক হাজার কেজি রসদ ও গোলা-বারুদ থাকতে পারে। সাধারণত, বড় কোনও অভিযানে নামলে এই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে দুনিয়ার তাবড় শক্তিশালী নৌবহর। ফলে ড্রাগনের মতলব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি। যদিও যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে চিনা বিদেশ মন্ত্রক।
বেজিঙের দাবি, অযথা বিষয়টিকে নিয়ে জলঘোলা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন মেনে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মোতায়েন রয়েছে পিএলএ নৌবাহিনী। কোনও দেশের উপর হামলার পরিকল্পনা নেই তাদের। এই আবহে সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে পীত সাগরের দক্ষিণ অংশ, পূর্ব চিন সাগর, দক্ষিণ চিন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সব মিলিয়ে শতাধিক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রেখেছে ড্রাগন। ফলে সেখানে তৈরি হচ্ছে ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’।
অসিদের পাশাপাশি দক্ষিণ জাপানের প্রশাসনিক এলাকা ওকিনাওয়াতে ‘দাদাগিরি’ চালানোর অভিযোগ উঠেছে চিনা নৌসেনার বিরুদ্ধে। সেখানে পরিস্থিতি এতটাই জটিল ছিল যে, মুহূর্তের অসতর্কতায় ধ্বংস হত টোকিয়োর লড়াকু জেট। একে যুদ্ধের উস্কানি বলে উল্লেখ করে সুর চড়িয়েছে সামুরাই রাষ্ট্র। পাল্টা জাপানের বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ এনেছে ড্রাগন।
৭ ডিসেম্বর পিএলএ নৌবাহিনীর ‘আগ্রাসন’ নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিনজিরো কোইজ়ুমি। তাঁর দাবি, ‘‘ওকিনাওয়া দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে লিয়াওনিং নামের একটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেছে বেজিং। সেখান থেকে জে-১৫ লড়াকু জেট উড়ে এসে টোকিয়ো বায়ুসেনার একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানকে রেডার-লক করে ফেলে। ফলে জেটটির উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কোনও বিপদ ঘটেনি।’’ ওই ঘটনায় হতাহতের কোনও খবর নেই এবং কোনও যুদ্ধবিমানের ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন কোইজ়ুমি।
কী এই ‘রেডার লক’? প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, প্রতিটি যুদ্ধবিমানের ককপিটে থাকে একাধির সেন্সর এবং রেডার। এগুলির সাহায্যেই মাঝ-আকাশে লড়াই চালান পাইলট। ককপিটের রেডার শত্রুর জেটকে চিহ্নিত করতে এবং তাকে নিশানা করতে সাহায্য করে। এই পদ্ধতিতে মাঝ-আকাশে বিপক্ষের যুদ্ধবিমানের উপর নিশানা ঠিক করাকেই বলে ‘রেডার লক’। এক বার তা হয়ে গেলে অনায়াসে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সংশ্লিষ্ট জেটকে উড়িয়ে দিতে পারেন ককপিটের যোদ্ধা-পাইলট।
বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের কথায়, ‘রেডার লক’ অবস্থা থেকে যুদ্ধবিমানকে রক্ষা করা বেশ কঠিন। কারণ, নিশানা ঠিক করা থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, গোটা প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ফলে টোকিয়োর যোদ্ধা-পাইলট কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিনের ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র (পড়ুন এয়ার টু এয়ার মিসাইল) এসে ধাক্কা মারত তার জেটে। ‘ইজেকশন’-এর মাধ্যমে ককপিট থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে পারলেও যুদ্ধবিমানের ধ্বংস ছিল অবশ্যম্ভাবী।
চিনা লালফৌজের বিমানবাহিনী এবং নৌসেনার লড়াকু জেট পাইলটদের কাছে আছে ‘বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ’ ক্ষেপণাস্ত্র। ফলে শত্রুর যুদ্ধবিমানকে চোখে দেখে হামলা চালানোর প্রয়োজন নেই তাঁদের। ককপিটের রেডারে এক বার সেটা ধরা পড়লেই ওই ক্ষেপণাস্ত্র চালাতে পারবেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে নিখুঁত নিশানায় ছুটে গিয়ে শত্রুর যুদ্ধবিমান ধ্বংস করবে ওই হাতিয়ার। লড়াকু জেট থেকে নির্গত হওয়া তাপ চিনে নিয়ে তাড়া করে তার উপর হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এই ক্ষেপণাস্ত্রের।
জাপানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, গত ৬ ডিসেম্বর ওকিনাওয়া দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় রুটিন টহলদারি চালাচ্ছিল তাদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান। ওই সময় অন্তত দু’বার টোকিয়োর এফ-১৫ জেটকে ‘রেডার লক’ করে চৈনিক নৌবাহিনীর জে-১৫। প্রথম ঘটনাটি ঘটে বিকেল ৪টে ৩২ থেকে ৪টে ৩৫ মিনিটের মধ্যে। আর দ্বিতীয় বার সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ থেকে ৭টা ৭ মিনিটের মধ্যে সামুরাই যুদ্ধবিমানকে পিএলএ পাইলট নিশানা করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
গত বছরের জুনে ফিলিপিন্সের জলসীমায় ঢুকে ‘গুন্ডাগিরি’ চালায় চিনা নৌবাহিনী। ম্যানিলার একটি ছোট্ট রণতরীতে সটান এসে ধাক্কা মারে পিএলএ-র যুদ্ধজাহাজ। এর পর লাঠি-ছুরি নিয়ে ফিলিপিন্সের জলযানে উঠে সেখানে মোতায়েন সৈনিকদের উপর অতর্কিতে হামলা চালায় বেজিঙের মেরিন কম্যান্ডোরা। তাঁদের থেকে এম-৪ রাইফেল কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে ড্রাগনের বিরুদ্ধে, যা নিয়ে পরে দায়সারা গোছের বিবৃতি দেয় মান্দারিনভাষীরা।
পিএলএ-র ‘দৌরাত্ম্য’ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ৭ ডিসেম্বর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন জাপান এবং অসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সেখানে ‘কৌশলগত সামরিক সমন্বয়’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত জুলাইয়ে চিন সফর করেন অসি প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনিও অ্যালবানিজ়। সেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা বলতে শোনা গিয়েছিল তাঁকে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই নীতি থেকে ক্যানবেরা সরবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।