বছরের শেষে লগ্নিকারীদের জন্য সুখবর। সোনার পাশাপাশি রকেটগতিতে বাড়ছে রুপোর দর। ফলে ‘সাদা ধাতু’ থেকে দুর্দান্ত রিটার্ন পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ডিসেম্বরেই কি দু’লক্ষ টাকা ছাপিয়ে যাবে রুপোর দাম? এই নিয়ে জল্পনার মধ্যেই ‘হলুদ ধাতু’র সঙ্গে রুপোয় লগ্নির মুনাফা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় মেতেছে দেশের তাবড় ব্রোকারেজ ফার্ম। তাদের দাবি, অঙ্কের হিসাবে সোনার চেয়ে রুপোয় পকেট গরম হয়েছে বেশি।
চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর ‘মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ’ বা এমসিএক্সে দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ দু’শতাংশ বেড়ে কেজি প্রতি ‘সাদা ধাতু’ পৌঁছোয় ১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকায়। এই বাজারে গত মার্চে রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে রুপোর দাম। ওই সময় কেজিতে এর দর ছিল ১ লক্ষ ৯১ হাজার ৮০০ টাকা। মাত্র ন’মাসের মাথায় নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙল ‘সাদা ধাতু’।
ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরে এখনও পর্যন্ত স্পট রুপোর দাম বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। সোনার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি ৬৮ শতাংশে আটকে আছে। গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ৩১ ডিসেম্বর স্পট রুপো বিক্রি হয়েছিল ৮৫ হাজার ৮৫১টাকা/কেজি দরে। ২০২৫ সালের ৯ ডিসেম্বরে সেই দামই উঠে আসে ১ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮৬১ টাকায়। অন্য দিকে ১০ গ্রাম ‘হলুদ ধাতু’র ক্ষেত্রে এই দুই তারিখে দাম ছিল যথাক্রমে ৭৫ হাজার ৯১৩ টাকা এবং ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৭৬২ টাকা।
বিশ্লেষকদের দাবি, রুপোর চাহিদা যে ভাবে বাড়ছে তাতে বর্ষশেষের আগেই কেজিতে দু’লক্ষ টাকায় পৌঁছোবে ‘সাদা ধাতু’র দর। শুধু তা-ই নয়, সেটা ২.১ লক্ষ টাকাতেও চলে যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ‘রিলায়্যান্স সিকিউরিটিজ়’-এর সিনিয়র রিসার্চ অ্যানালিস্ট জিগর ত্রিবেদী। তাঁর কথায়, ‘‘দেশীয় লগ্নিকারীদের পাশাপাশি বছরের শেষে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় রুপোর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আরও চাঙ্গা হবে এর দাম।’’
বর্তমানে সোনা-রুপোর অনুপাত প্রায় ৬৮-৬৯-এ দাঁড়িয়ে আছে, গত তিন চার বছরের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। ‘সাদা ধাতু’র জন্য এটা আর একটা ভাল সূচক, বলছেন বিশ্লেষকেরা। গত ৬-৮ মাসের মধ্যে রুপোর দাম বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এর নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত, মার্কিন শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ, শিল্পগত চাহিদা বৃদ্ধি এবং মিউচুয়াল ফান্ডের এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) রুপোয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্প সংস্থায় বহুল পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে রুপো। ‘সাদা ধাতু’র রফতানি বাড়িয়েছে চিন। অন্য দিকে এর আমদানি বৃদ্ধি করেছে ভারত। ফলে চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার তার প্রভাব দামে দেখা যাচ্ছে।
এ বছরের ডিসেম্বরের শেষে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজ়ার্ভের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথের পর ওই ব্যক্তি সুদের হার কমাবেন বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল। ফেড রিজ়ার্ভ সুদ কমালে সোনা-রুপোর বাড়বে লগ্নি। তখন ‘সাদা ধাতু’র দামের সূচক যে আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে, তা বলাই বাহুল্য।
১০ ডিসেম্বর এক দিনের মধ্যে কলকাতায় প্রতি কিলোগ্রাম খুচরো রুপোর দাম বেড়েছে ৮৭০০ টাকা। নজির গড়ে ‘সাদা ধাতু’ পৌঁছে গিয়েছে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৭৫০ টাকায়। পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) ধরে দাম ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৩৮৩ টাকা। অন্য দিকে ১০ গ্রাম খুচরো সোনা (২৪ ক্যারাট) ৫৫০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, সোনার দাম বাড়তে থাকায় অনেকেই ঝুঁকেছিলেন রুপোর দিকে। ফলে রুপোর গয়না এবং বাসন, দু’টিরই চাহিদা বেড়ে যায়। এ বার তা কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অলঙ্কার সংস্থা ‘সেনকো গোল্ড’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শুভঙ্কর সেন বলেন, ‘‘রুপোর খনিতে উৎপাদন কমছে। এতে সরবরাহ কমায় লাফিয়ে বাড়ছে দাম।’’
বর্তমানে জেট বিমান, মহাকাশযান এবং সেমিকন্ডাক্টর-সহ একাধিক বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম-সহ সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে রুপো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এগুলির নির্মাণ দেশে বেড়ে যাওয়ায় ‘সাদা ধাতু’র চাহিদা হঠাৎ করে আকাশছোঁয়া হয়েছে। আমজনতার অনেকেই বেশি লাভের আশায় রুপোয় বিনিয়োগ করছেন। সেটাও এর দামবৃদ্ধির একটা কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ৫ ডিসেম্বর ফের একবার রেপো রেট হ্রাস করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সুদের হার ৫.২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এর জেরে এক দিকে যেমন ভাসমান সুদের হারে গাড়ি-বাড়ির ঋণ কমতে শুরু করেছে, অন্য দিকে তেমন স্থায়ী আমানত বে মেয়াদি আমানতগুলির সুদ কমাচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্ক। ফলে বাধ্য হয়ে লগ্নি অন্যত্র সরাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
চলতি বছরে শেয়ার সূচককে কখনওই টানা বাড়তে দেখা যায়নি। তা ছাড়া লার্জ ক্যাপ সংস্থাগুলি যতটা মুনাফা দিতে পেরেছে মিড বা স্মল ক্যাপে তার সিকি ভাগও হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে আমজনতা। সেখানে কাগুজে সোনা বা রুপোয় বিনিয়োগ তাঁদের ‘অটোমেটিক চয়েস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ডোমেস্টিক কাউন্সিলের ডিরেক্টর সমর দে জানিয়েছেন, বিশ্ব জুড়ে লগ্নির অনিশ্চিত বাজারে সোনা-রুপোয় লগ্নি বেড়েছে। আবার সোনার দাম আকাশ ছোঁয়ায় অনেকে আঁকড়ে ধরেছেন রুপোকে। বড় লগ্নিকারীরা পণ্য লেনদেনের বাজারে এই ধাতু কিনছেন। সাধারণ লগ্নিকারীদের অনেকে বেছে নিচ্ছেন, সিলভার ইটিএফ (রুপো নির্ভর এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড)-কে। কেউ কেউ সোনার বদলে রুপোর গয়না, বাসন কিনছেন। এগুলি দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
ওয়েস্ট বেঙ্গল বুলিয়ন মার্চেন্টস অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি দীনেশ কাবরার আবার মনে করেন, রুপোর এই হারে দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কারণ, ঐতিহাসিক ভাবে সোনার দাম বৃদ্ধির সঙ্গে রুপোর মাথা তোলার সমীকরণ রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে তা বাড়ে। সাধারণ ভাবে এক আউন্স সোনার দামের সমান হওয়া উচিত ৬৫-৭৫ আউন্স রুপোর দর।
গত ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব বাজারে বাজারে প্রতি আউন্স সোনা এবং রুপো ছিল যথাক্রমে ৪২০০ এবং ৬১ ডলার। অর্থাৎ এক আউন্স সোনার দামে মিলছে ৭০ আউন্স রুপো। কাবরা বলেন, ‘‘এখন সোনা-রুপোর দামের অনুপাত প্রায় ঠিক জায়গায় চলে এসেছে। তাই সোনা না চড়লে রুপো নিয়ে আশঙ্কা কম।’’
পরিসংখ্যানে প্রকাশ, গত এক মাসে অনেক দ্রুত হারে বাড়তে দেখা গিয়েছে রুপোকে। কলকাতায় ১০ নভেম্বর থেকে ১০ গ্রাম (২৪ ক্যারাট) খুচরো সোনার দাম বেড়েছে ৫৯০০ টাকা। এই সময়ে প্রতি কিলো খুচরো রুপোর ক্ষেত্রে তা ৩৪,৯৫০।
ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে স্পট রুপোর দাম এখনও পর্যন্ত ১১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ‘সাদা ধাতু’র দরে ২০-৪০ শতাংশ সংশোধন আসতে পারে। তবে এতে বিনিয়োগের চাহিদা শক্তিশালী থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বুলিশ ট্রেন্ডের আপাতত বদল হওয়ার সম্ভাবনা কম, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে এগুলির উল্টো যুক্তিও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ধীরে ধীরে স্থিরতার দিকে যাচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত। পূর্ব ইউরোপে রুশ-ইউক্রেন বা পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের গতি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ফলে রুপোর দামের যে কোনও সময়ে বুদবুদ ফাটতে পারে। আর তাই ‘সাদা ধাতু’তে লগ্নির আগে বিশ্লেষকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেছেন তাঁরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।