বারমুডা দ্বীপের নীচে সমুদ্রতলের গভীরে রহস্যময় কাঠামো খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: আইস্টক।
বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল। নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে অজস্র রহস্য। অতলান্তিক মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তের এই অংশেই নাকি অতীতে উধাও হয়ে গিয়েছে বহু জাহাজ এবং বিমান। কেন? উত্তর মেলেনি। অবশেষে কি সেই জটিল ধাঁধার সমাধান হতে চলেছে? নতুন এক গবেষণায় বারমুডা নিয়ে আশার আলো দেখতে পেলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, এই অংশের সমুদ্রের নীচে বিশাল এক রহস্যময় কাঠামোর খোঁজ মিলেছে। এমন এক পাথুরে কাঠামো, পৃথিবীর আর কোথাও কখনও যা দেখা যায়নি!
অতলান্তিকের রহস্যময় এলাকাকে চিহ্নিত করতে কাল্পনিক ত্রিভুজাকার সীমা টেনে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পুয়ের্তো রিকো, মিয়ামি আর বারমুডাকে অদৃশ্য রেখায় জুড়লেই পাওয়া যায় কুখ্যাত বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল। নতুন গবেষণা বলছে, এই অঞ্চলের সমুদ্রতলের (ওশানিক ক্রাস্ট) ঠিক নীচে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিস্তৃত একটি পাথরের স্তর রয়েছে। অন্য কোথাও সমুদ্রের নীচে এমন স্তরের অস্তিত্ব নেই। অন্তত বিজ্ঞানীদের এমন কোনও স্তরের কথা জানা নেই। একটি পাথরের কাঠামো বারমুডাকে আলাদা করে দিয়েছে বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে।
আমেরিকার এক দল বিজ্ঞানী দীর্ঘ দিন ধরে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরাই এই রহস্যময় পাথরের স্তরের হদিস পেয়েছেন। জিয়োফিজ়িক্যাল রিসার্চ লেটার্স নামক পত্রিকায় তাঁদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। কাঠামোটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষকদলের প্রধান উইলিয়াম ফ্রেজ়ার বলেন, ‘‘সাধারণত সমুদ্রতল শেষ হলে ম্যান্টেল (পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ স্তর) শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বারমুডায় তা হয়নি! বারমুডা যে ভূগর্ভস্থ পাতের উপর রয়েছে, তার মধ্যে সমুদ্রতলের নীচে ম্যান্টেলের আগে আরও একটি স্তর রয়েছে।’’ কেউ যেন জোর করে স্তরটি সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে, দাবি বিজ্ঞানীদের। ফ্রেজ়ার জানিয়েছেন, এই স্তরের উৎস এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বারমুডাকে ঘিরে যে রহস্য রয়েছে, তার ব্যাখ্যা মিলতে পারে এই স্তর থেকে।
এমনিতেই বারমুডার কাছে দ্বীপপুঞ্জের ভূমিরূপ কিছুটা আলাদা। এই অংশের সমুদ্র তুলনামূলক ফুলেফেঁপে থাকে। জলস্তরও চারপাশের চেয়ে উঁচু। কিন্তু এই উচ্চতার কোনও জুতসই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অনেকে বলেন, সমুদ্রের নীচে থাকা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং মিথেন গ্যাসের নিষ্ক্রমণ জলস্তর বৃদ্ধির কারণ। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দাবি, বারমুডার আশপাশে সমুদ্রের নীচে অগ্নুৎপাতের প্রমাণ মেলেনি। শেষ বার এখানে অগ্নুৎপাত হয়েছিল ৩.১ কোটি বছর আগে। তবে ওই সময়ের আগে বারমুডা সংলগ্ন এলাকায় আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল, নিয়মিত অগ্নুৎপাত হত।
বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, ৩.১ কোটি বছর আগের সেই ধারাবাহিক অগ্নুৎপাত থেকেই রহস্যের সূত্রপাত। অগ্নুৎপাতের কারণে ম্যান্টেল অংশের পাথর ঢুকে গিয়েছিল সমুদ্রতলের ত্বক বা ক্রাস্টের মধ্যে। কোথাও কোথাও তা এখনও আটকে আছে। সমুদ্রতলকে তা অন্তত ১৬৪০ ফুট উঁচু করে তুলেছে। সমুদ্রতল ফুলে থাকা অবশ্য বিরল নয়। হাওয়াই-সহ একাধিক দ্বীপশৃঙ্খল তৈরিই হয়েছে ‘ম্যান্টেল হটস্পট’-এর কারণে। ম্যান্টেলের উষ্ণ পদার্থ উপরে উঠে এলে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ শুরু হয়। ওই হটস্পট ভূ-ত্বকের সংস্পর্শে এলে সমুদ্রতল ফুলে ওঠে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পাত নড়াচড়া করলেই আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বারমুডায় তা হয়নি। তিন কোটি বছর ধরে কোনও আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তা না-থাকা সত্ত্বেও কেন সমুদ্রত্বক আগের অবস্থায় ফিরল না, সেটা বড় রহস্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বারমুডার নীচে ম্যান্টেল অংশে এমন কিছু ঘটছে, উপরে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ফলে তা অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। ম্যাসাচুসেটসের ভূবিজ্ঞানী সারা মাজ়ার কথায়, ‘‘বারমুডার নীচে সক্রিয় অগ্নুৎপাতের দিনগুলির কিছু অবশেষ এখনও রয়ে গিয়েছে। সেই কারণেই অতলান্তিকের ওই নির্দিষ্ট অংশ পারিপার্শ্বিকের চেয়ে উঁচু।’’
সমুদ্রত্বকের নীচে কী ভাবে নতুন পাথুরে কাঠামোর খোঁজ পাওয়া গেল? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বড়সড় ভূমিকম্পগুলির ভূগর্ভস্থ রেকর্ডিং সংগ্রহ করেছিল মার্কিন ওই গবেষকদল। তা থেকে তারা বারমুডার নীচে অন্তত ৫০ কিলোমিটার গভীরের চিত্র পেয়েছেন। ভূকম্পনের তরঙ্গ যে যে অংশে এসে হঠাৎ করে বদলে গিয়েছে, সেই অংশগুলিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার মাধ্যমেই অস্বাভাবিক এবং অজানা এই দীর্ঘ পাথরের স্তরের হদিস পাওয়া গিয়েছে। এই স্তরের পাথরের ঘনত্ব আশপাশের অন্য পাথরের চেয়ে কম।
বারমুডার কাছে গিয়ে জাহাজ বা বিমান গায়েব হয়ে যাওয়ার রহস্যের সঙ্গে সমুদ্রতলের নীচের এই পাথুরে স্তরের কী সম্পর্ক, এখনও তা স্পষ্ট নয়। কেন উধাও হয়ে যাওয়া কোনও জাহাজ বা বিমানের ধ্বংসাবশেষটুকুও কখনও পাওয়া যায়নি, কেনই বা মেলেনি কোনও মৃতদেহ, উত্তর বিজ্ঞানের অজানা। তবে এই ২০ কিলোমিটারের পাথর সমাধানের ইঙ্গিত বয়ে আনতে পারে। তা নিয়ে আরও গবেষণা, আরও বিশদ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।