Accidental Death

আমার ছেলের প্রাণটা চলে গেল শ’তিনেক টাকার জন্য

অরণ্য ডব্লিউডব্লিউএ কাশীপুর ইংলিশ স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত। প্রতিদিনের মতো সে দিনও বরাহনগরের দুইয়ের পল্লির বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল সে। সিগন্যাল লাল হয়ে যাওয়ায় বি টি রোডে রাস্তার একেবারে বাঁ দিকে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ও।

সমীরণ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৫
ছেলে অরণ্যর জন্মদিন পালনের ছবি মোবাইলে দেখছেন বাবা সমীরণ চক্রবর্তী।

ছেলে অরণ্যর জন্মদিন পালনের ছবি মোবাইলে দেখছেন বাবা সমীরণ চক্রবর্তী। ছবি: সুমন বল্লভ।

আসতে চলেছে আরও একটা নতুন বছর। চার পাশে বর্ষবরণের উন্মাদনা, নতুন বছর ঘিরে মানুষের নানা পরিকল্পনা। কিন্তু আমাদের জীবনটা থমকে গিয়েছে ২৮ নভেম্বরেই। ওই দিন আমাদের একমাত্র ছেলে অরণ্যকে পিষে দিয়েছিল বেপরোয়া বাস। তার পর থেকে আমার আর আমার স্ত্রী কস্তুরীর জীবনটাই যেন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে।

অরণ্য ডব্লিউডব্লিউএ কাশীপুর ইংলিশ স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত। প্রতিদিনের মতো সে দিনও বরাহনগরের দুইয়ের পল্লির বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল সে। সিগন্যাল লাল হয়ে যাওয়ায় বি টি রোডে রাস্তার একেবারে বাঁ দিকে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ও। সেখানেই ওকে ধাক্কা মারে ২৩৪ নম্বর রুটের একটি বাস। পরে জানতে পেরেছি, ২৩০ নম্বর রুটের একটি বাসের সঙ্গে রেষারেষি করছিল ওই বাসটি। ২৩০ নম্বর রুটেরবাসটিকে বাঁ দিক থেকে ওভারটেক করতে গিয়েই অরণ্যকে ধাক্কা মারে সেটি। আমার ছেলের তো কোনওদোষ ছিল না। ও তো রাস্তার একেবারে বাঁ দিকেই দাঁড়িয়ে ছিল। কেন ২৩৪ নম্বর রুটের বাসটি নিয়ম ভেঙে সামনের বাসটিকে বাঁ দিক দিয়ে ওভারটেক করতে গেল? সামনেই চিড়িয়ামোড়। ওভারটেক করে এগিয়ে যেতে পারলে সেখান থেকে হয়তো ১০-২০ জন যাত্রী বেশি পেত বাসটি। যাঁদের টিকিট থেকে হয়তো ৩০০ টাকার মতো আয় হত। আমার ছেলের প্রাণটা চলে গেল শ’তিনেক টাকার জন্য।

শুনেছি, রাজ্য সরকার বাসের কমিশন প্রথা তুলে দিয়ে ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের জন্য বেতন ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিল। বাসমালিকেরা আন্দোলন করে তা হতে দেননি। এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে যাত্রী তোলার জন্য বাসে-বাসে রেষারে‌ষি হয়তো হত না। যে রেষারেষির খেসারত দিতে হয়েছে আমাকে আর আমার স্ত্রীকে। আমাদের ছেলেটাকে।

অরণ্যর দুর্ঘটনার কয়েক দিন পরেই বাবার সঙ্গে মোটরবাইকে চেপে স্কুলে যাওয়ার সময়ে মানিকতলা বাস ডিপোর কাছে বেপরোয়া লরির ধাক্কায় মারা গিয়েছে বছর এগারোর সৃঞ্জয় দত্ত। আমার ছেলেও সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য, তাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল দেন মুখ্যমন্ত্রী। তা হলে পড়ুয়াদের স্কুলে যাতায়াতের সময়ে পথে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশ-প্রশাসন আরও তৎপর হয় না কেন? কেন তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই? সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময়ে এবং ছুটির পরে স্কুল থেকে ফেরার সময়ে পড়ুয়াদের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। রাস্তায় দু’টি বাস রেষারেষি করলে, বেপরোয়া গতিতে কোনও গাড়ি ছুটলে পুলিশকে তা আটকাতে হবে। এই সব ব্যবস্থা থাকলে অরণ্য এবং সৃঞ্জয়কে অকালে চলে যেতে হত না।ঘাতক বাসটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর। ঠিক এক বছর পরে, ২০২৫-র ২৮ নভেম্বর বাসটি ছেলেকে ধাক্কা মারল। এই ঘটনার আগে বাসটির বিরুদ্ধে ৬৪টি কেস ছিল। অরণ্যকে ধাক্কা দেওয়ার পরে কেসের সংখ্যা হয়েছে ৬৫। মাত্র এক বছরে বাসটির বিরুদ্ধে এতগুলি কেস! এতগুলি কেস নিয়ে বাসটি রাস্তায় চলছিল কী ভাবে? এক পুলিশকর্মী আমায় বলেছেন, ‘রাস্তায় বাস চললে এ রকম কেস হয়!’ এই ভাবে দুর্ঘটনায় একটার পর একটা প্রাণ চলে যাওয়ার পরেও কি পুলিশ কোনও শিক্ষা নেবে না?

আমার বন্যপ্রাণ ফোটোগ্রাফির শখ রয়েছে। পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে ছবি তুলেছি। অরণ্যও বিষয়টি নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ছবি তুলত। সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনটাই হারিয়ে গেল।

অরণ্যর দুর্ঘটনার পরে তার পরিচয়পত্র দেখে এক পথচারী আমাকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিলেন। ছেলেকে কাছেই একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি সেই নার্সিংহোমে ছুটে যাই। তত ক্ষণে সব শেষ। সেখান থেকে আমার ছেলের দেহ নিয়ে যাওয়া হয় আর জি কর হাসপাতালে। সেখানেই ময়না তদন্ত হয়। বাগমারির বাসিন্দা গৌতম দত্তের ছেলে সৃঞ্জয় দুর্ঘটনার পরে লড়াই করেছিল। খুব কষ্ট পেয়েছে বাচ্চাটা। আমার ছেলেটা তো দুর্ঘটনার পরেই মারা যায়। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আর কাউকে যেন এমন সহ্য করতে না হয়।

সমীরণ চক্রবর্তী (দুর্ঘটনায় মৃত ছাত্র অরণ্য চক্রবর্তীর বাবা) অনুলিখন: মিলন হালদার

আরও পড়ুন