(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু অধিকারী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ব্রিগেড ময়দানে গীতা পাঠের দিন চিকেন প্যাটিস বিক্রি করতে চাওয়ায় বিক্রেতাদের হেনস্থার অভিযোগে বুধবার রাতে তিন জনকে গ্রেফতার করল ময়দান থানা। এর পরে, বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরে দলীয় সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, এটা উত্তরপ্রদেশ নয়, অভিযুক্তদের ধরা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের কিছু ক্ষণ পরেই ব্যাঙ্কশাল আদালত থেকে জামিনও পেয়ে গিয়েছেন তিন ধৃত। আর তার পরেই ‘হিন্দু-একতা’র বার্তা দিয়ে তিন জনকে কলকাতায় মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানালেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
বিক্রেতাদের হেনস্থার অভিযোগে উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার সৌমিক গোলদার, অশোকনগরের স্বর্ণেন্দু চক্রবর্তী, হুগলির উত্তরপাড়ার তরুণ ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতদের আদালতে তোলা হলে, তাঁদের জামিনের আর্জি জানিয়ে আইনজীবীরা দাবি করেন, ময়দানে ভিড়ের মধ্যে অভিযুক্তেরা থাকলেও, তাঁরা কাউকে হেনস্থা করেননি। সৌমিক ক্যানসারে আক্রান্ত, তাঁর একটি পা বাদ গিয়েছে। জামিনের বিরোধিতা করে ধৃতদের ১৪ দিন জেল হেফাজতে পাঠানোর আর্জি জানিয়ে সরকারি আইনজীবীর পাল্টা দাবি, ওই বিক্রেতাদের আটকে রেখে মারধর ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে। শেষে তিন জনেরই এক হাজার টাকা বন্ডে জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন বিচারক।
এর অনতি-আগে ঘটনাটি নিয়ে ‘কড়া বার্তা’ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কৃষ্ণনগরের সভা থেকে বলেছেন, “এক জন গরিব হকার জিনিসপত্র বিক্রি করতে গিয়েছেন। তাঁর মাথায় তখন এটা খেলেনি, এটা না ওটা বিক্রি করব। তাঁকে ধরে মেরেছে। যাঁরা গায়ে হাত দিয়েছেন, সব ক’টাকে গ্রেফতার করেছি। এটা বাংলা, এটা ইউপি (উত্তরপ্রদেশ) নয়। এখানে তোমাদের গদ্দারি, হুকুম, আদেশ চলবে না।” এই প্রেক্ষিতে সন্দেশখালিতে আদালতের যাওয়ার সময়ে ট্রাকের ধাক্কায় দু’জনের মৃত্যু নিয়ে বন্দি তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহান এবং তাঁর দলবদলের দিকে যে অভিযোগ উঠেছে, সে দিকে ইঙ্গিত করেছেন বিরোধী নেতা শুভেন্দু। শুভেন্দু নন্দীগ্রামে বলেছেন, “(ট্রাকের ধাক্কা কাণ্ডে) গ্রেফতার করবে না। ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতি। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৪১ নম্বর ধারার নোটিস না-দিয়ে অশোকনগর, গোবরডাঙা থেকে হিন্দু ভাইদের গ্রেফতার করেছে। মমতার পুলিশ যে সব হিন্দু ভাইদের উপরে অত্যাচার করবে, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে হিন্দু হিসাবে তাঁদের পাশে থাকব।” অভিযুক্তদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা, আইনি সাহায্য, তাঁদের বাড়িতে নিজের দল পাঠানোর কথা জানিয়েছেন শুভেন্দু।
বিজেপিকে নিশানা করে পাল্টা তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, “এটাই বিজেপির স্বাভাবিক কাজ। রাজ্যবাসীর সতর্ক হওয়ার সুযোগ। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে এই ব্যবস্থাই কায়েম হয়েছে।” তবে তৃণমূল ও বিজেপি, দু’পক্ষকেই নিশানা করেছে সিপিএম। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “চাপে পড়ে গ্রেফতার, তার পরে জামিন এবং সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তদের বিরোধী নেতার সংবর্ধনা! ক্ষমতায় এলে এঁরা বাঙালির মাছ-ভাতও বন্ধ করবেন! সরকার প্রথমে ব্যবস্থা নেয়নি, বামপন্থী আইনজীবী-সহ কয়েক জন অভিযোগ করার পরে গ্রেফতার করা হলেও এমন ধারা দেওয়া হয়েছে, যাতে সহজে জামিন হয়। আর শুভেন্দু সংবর্ধনা দিতে পারেন, এমন চিত্রনাট্য তৈরিতে মমতাও অংশীদার হলেন!”
প্যাটিস-কাণ্ডে গ্রেফতার ও অভিযুক্তদের মুখ ঢেকে আদালতে আনার প্রতিবাদে এ দিন আদালত চত্বরেই গেরুয়া পতাকা হাতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। স্লোগান ওঠে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই’। পাশাপাশি, গীতা পাঠের দিন এক বিক্রেতা নিরামিষ বলে চিকেন প্যাটিস বিক্রি করেছেন বলে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হলেও, কেন পদক্ষেপ করা হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিজেপি নেতা দেবজিৎ সরকার। অশোকনগরেও ৮ নম্বর মোড় থেকে থানার সামনে পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেছে সনাতনী হিন্দু সমাজ এবং এবিভিপি। থানায় দাবিপত্রও দেওয়া হয়েছে। সৌমিকের মা ইতিকা বলেছেন, “ছেলে অসুস্থ ছিল। গীতা পাঠ উপলক্ষে নিরামিষ খাবার খাচ্ছিল। নিরামিষ বলে বিক্রেতার দেওয়া চিকেন প্যাটিস মুখে দিয়ে রেগে গিয়ে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে ছেলে।”
গীতা পাঠের ওই আয়োজনকেও নিশানা করেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, “আমরা সবাই বাড়িতে গীতা পাঠ করি। জনসভা করার কী আছে? যিনি আল্লাহের কাছে দোয়া করেন, তিনি মনে মনে মানেন। রমজান, নমাজের সময় সবাই এক সঙ্গে যান। যখন দুর্গাপুজো হয়, তখন সবাই এক সঙ্গে মিলেমিশে আমরা পুজো করি। শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, ধর্ম মানে ধারণ করা। হিংসা, ভেদাভেদ নয়। বিজেপির বন্ধুরা, যাঁরা গীতাপাঠ করছেন, আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। উত্তর দেবেন।”