বাংলাদেশে ‘প্রথম আলো’র দফতরে ভাঙচুর-তাণ্ডব চালান বিক্ষোভকারীরা। ‘প্রথম আলো’র কার্যনির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ (ইনসেটে)। ছবি: রয়টার্স।
তাণ্ডব শুরুর কয়েক মুহূর্ত আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন। তার পর খবর পান। কিন্তু ফেরার রাস্তা বন্ধ। কারণ, একদল তাণ্ডব চালাচ্ছে ‘প্রথম আলো’র দফতরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’র কার্যনির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঙ্গে যখন কথা বলল আনন্দবাজার ডট কম, তখনও তাঁর গলায় বিস্ময়। বিশ্বাস করতে পারছেন না। বললেন, ‘‘এখনও ভাবতে পারছি না এমনটা ঘটতে পারে! স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এটা একটা কালো দিন।’’ কেন হল এমন? কারা করল? সাজ্জাদ বললেন, ‘‘আমাদের প্রতিষ্ঠান তো গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নিয়ে সরব। সেই প্রতিষ্ঠানের উপরেই ওরা আঘাত হানল।’’ এই ওরাটা কারা? তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি সাজ্জাদ। বলছেন, ‘‘প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে যা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করে কী আর করব! প্রশাসন তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনুক, এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।’’
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার কারওয়ান বাজারে ‘প্রথম আলো’র অফিসে হামলা চালানো হয়। সেই সময়ে কর্মরত সাংবাদিকেরা অনলাইন সংবাদ–পোর্টাল চালানোর পাশাপাশি শুক্রবার ভোরের কাগজ প্রকাশের কাজ করছিলেন। ‘প্রথম আলো’র কর্মীরা আচমকা এই হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন বোধ করেন। প্রাণ সংশয়ের অবস্থা তৈরি হয়। আক্রমণকারীরা অফিস-ভবন ব্যাপক ভাবে ভাঙচুর করে। পরে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর ফলে অফিস-ভবন পুড়ে যায়। ভস্মীভূত হয় মূল্যবান নথিপত্র। স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ রাখতে হয় কাজ।
রাস্তায় পড়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া নথি। ছবি: রয়টার্স।
সাজ্জাদ জানালেন, এখনও চারধারে দগদগে হয়ে রয়েছে বৃহস্পতিবার রাতের দৃশ্যপট। আনাচকানাচ থেকে পাওয়া যাচ্ছে পোড়া গন্ধ। চতুর্দিকে ভাঙচুরের চিহ্ন। যেন একটা ধ্বংসাবশেষ। প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরের ইতিহাসে, কোনও ছুটি বাদে, পত্রিকাটি এই প্রথম প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি শুক্রবার। অনলাইনের কার্যক্রমও দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখতে হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত একটা অংশের মতে, প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার এখনও বিপন্মুক্ত নয়। কারণ হিসাবে তাঁরা জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবার রাতে প্রশাসনের ভূমিকায় ফাঁক ছিল অনেকটা। কেন, এখনও তা স্পষ্ট হয়নি। তাঁদের মতে, অন্তবর্তী সরকার একই সঙ্গে ‘দুর্বল’ এবং ‘অনিচ্ছুক’। এই সময়টা তাই খুবই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু কেন প্রথম আলোর উপরেই শুধু আক্রমণ করা হল? ওই অংশের মতে, এর নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম দেশীয় সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ‘প্রথম আলো’র প্রভাব বাংলাদেশ জুড়েই রয়েছে। যে অংশ দেশে সুস্থিত গণতন্ত্র চায় না, নির্বাচন চায় না— তারাই পরিকল্পিত ভাবে শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পরে এই আক্রমণ চালিয়েছে। যাতে সেই প্রভাবে প্রতীকী এবং বাস্তবিক ভাবে আঘাত হানা যায়। অন্য একটা অংশের মতে, যে গোষ্ঠী এই আক্রমণ চালিয়েছে তারা দেশের ভাবমূর্তি উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই নষ্ট করতে চেয়েছে বিশ্বের কাছে।
আনন্দবাজার ডট কম ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে কথা বলার আগেই এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয় ওই সংবাদমাধ্যমের তরফে। সেখানে লেখা হয়, ‘প্রথম আলো অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বিভিন্ন বাহিনীসহ নানা মহলের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পৌঁছোনোর আগেই অফিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কর্মরত উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও কর্মীরা জীবন বাঁচাতে কার্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।’
আগুনে ভস্মীভূত বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’-র দফতর। ছবি: রয়টার্স।
একই কথা বলছেন সাজ্জাদ। একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘শরিফ ওসমান হাদির দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিত ভাবে এ সব আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য এ ছিল একটি কালো দিন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুধু আগামী নির্বাচনকে পথভ্রষ্ট করার প্রচেষ্টাই চালানো হয়নি, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করারও লক্ষ্য ছিল।’’
তবে থেমে থাকছে না ‘প্রথম আলো’। ধ্বসংস্তূপের মধ্য থেকেই সাংবাদিকতার নতুন আলোর সন্ধানে চলছে জোরকদমে কাজ। শনিবার ভোরে আবার প্রকাশিত হবে সংবাদপত্র। অনলাইনের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে।