Donald Trump

ট্রাম্পকে আর ভোট নয়, বলছেন অনেক ভারতীয়

আমেরিকা জুড়ে করা একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে সব প্রদেশে ট্রাম্প স্পষ্ট ব্যবধানে জিতেছিলেন, সেই ২০টি প্রদেশেই এখন তাঁর ‘অ্যাপ্রুভাল রেটিং’ বা গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম।

অভীক সানোয়ার রহমান
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৪১
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। — ফাইল চিত্র।

আমেরিকা জুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা দ্রুত নিম্নগামী। বিশেষ করে তাঁর সাম্প্রতিক ঘোষণার— ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে অভিবাসন ও ভিসা স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা হতে পারে’— পর থেকেই ভারত-সহ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা, যার পোশাকি নাম ‘গ্লোবাল সাউথ’, থেকে আগত অভিবাসীদের মধ্যে প্রবল অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই নীতিগত অবস্থান শুধু জাতিগত বিভাজন নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। আমেরিকা জুড়ে করা একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে সব প্রদেশে ট্রাম্প স্পষ্ট ব্যবধানে জিতেছিলেন, সেই ২০টি প্রদেশেই এখন তাঁর ‘অ্যাপ্রুভাল রেটিং’ বা গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম।

বিভিন্ন সংস্থা মিলে করা এই সমীক্ষা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ট্রাম্পের জাতীয় অনুমোদন ৪১ শতাংশ আর বিরোধিতা ৫৫ শতাংশের উপরে। মেরিল্যান্ডে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে ৪১.৫ শতাংশের মধ্যে, হাওয়াইয়ে ৩৫.৬ শতাংশে। এমনকি, ওকলাহোমার মতো ঐতিহ্যগত রিপাবলিকান প্রদেশে, ট্রাম্প সমর্থনকারীদের সংখ্যা ট্রাম্প-বিরোধীদের থেকে মাত্র ৭ শতাংশ বেশি। ওয়াইয়োমিং, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, আইডাহো ও মন্টানার মতো প্রদেশে ট্রাম্প এখনও এগিয়ে থাকলেও প্রবণতা স্পষ্ট, সমর্থন সঙ্কুচিত হচ্ছে।

এই রাজনৈতিক টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মনোভাব তৈরি হচ্ছে, তা-ও এই সমীক্ষার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ফ্লরিডায় বসবাসকারী সাংবাদিক সুকুমার রায়ের মতে, “আমরা ভারতীয়েরা প্রথমে ভেবেছিলাম, অভিবাসন-নীতি কঠোর হলেও এই নীতির লক্ষ্য মূলত মুসলিম-অভিবাসীরাই হবেন, ‘আমরা’ নই। কিন্তু এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাবে ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড’ শব্দটি ব্যবহার করছেন, তাতে ভারতও যে পরোক্ষ ভাবে একই টার্গেট গ্রুপের ভিতরে পড়ে যেতে পারে, তা স্পষ্ট।” সুকুমারবাবুর মতো অনেক ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরও অনেক অভিবাসীই বলছেন, “পরিবার, বাবা-মায়ের ভিসা, এইচ১-বি বা ছাত্রভিসা— সবই এখন অনিশ্চয়তার মুখে।” অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্টের শুল্ক-নীতি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সমস্যায় ফেলেছে। ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী জুনায়েদ শেখ বললেন, “শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় আমাদের সংস্থার ভারত-সংলগ্ন সরবরাহ-শৃঙ্খলে বড়সড় চাপ পড়ছে। তাতে চাকরি, বেতন, ব্যবসায়িক সম্পর্ক, সব কিছুতেই ক্ষতি হচ্ছে। ২০২৪ সালে ভারতীয়েরা যে ভাবে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন, এখন সেই সমর্থন আর নেই।”

ট্রাম্পের জমানায় এ দেশে বসবাসকারী ভারতীয় ও দক্ষিণ এশীয়দের ‘আত্মপরিচয়’ নিয়েও নানা প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। বিদ্বেষমূলক আচরণের আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে ট্রাম্পের ‘তৃতীয় বিশ্ব’ মন্তব্য, মত তাঁদের। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা মৃদুল পাঠক বলেন, “থার্ড ওয়ার্ল্ড শব্দ ব্যবহার করে আমাদের নীচে নামানো হচ্ছে। আমরা আমেরিকায় পড়াশোনা করেছি, কাজ করছি, কর দিই, তবু আমাদের প্রতি এত সন্দেহ কেন?” সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ট্রাম্পের প্রতি দেশবাসীর যে নেতিবাচক মনোভাব ফুটে উঠেছে, তার বাস্তব প্রতিফলন আমরা পাই মৃদুলের মতো অভিবাসীদের মন্তব্যে।

তবে মিশিগানের বাসিন্দা দেবাশিস চক্রবর্তী মনে করেন, ট্রাম্পের ভাষণ “বাস্তবে কার্যকর করা কঠিন”, কারণ ‘তৃতীয় বিশ্বের’ সব দেশের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে গেলে আমেরিকাের কূটনৈতিক, আইনগত এবং মানবাধিকার কাঠামোই অচল হয়ে পড়বে।” নিউ ইয়র্ক প্রবাসী এক আইনজীবী দিল্লি ভট্টও বললেন, “ঢালাও ভাবে অভিবাসন বন্ধ করতে গেলে বেশ কিছু আইনি বাধ্যবাধকতার মুখে পড়তে হবে। কংগ্রেসের অনুমতি লাগবে, আবার এগজ়িকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে আইন আনতে গেলেও বেশ কিছু অসুবিধা বা প্রক্রিয়াগত জটিলতা তৈরি হতে পারে, যার মীমাংসা আদালতে করতে হবে।”

এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয়রা এ কথাও খোলাখুলি বলছেন যে, “যেমন ভাবে ২০২৪ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিপুলসংখ্যক আমেরিকান ভোটার ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছিলেন, এখন ঠিক উল্টো দিকে সরে যাচ্ছেন অনেকেই।” তাঁদের মতে, অভিবাসন ও অর্থনৈতিক চাপের এই দ্বিমুখী আঘাত ২০২৬-এর মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভোটের ফল প্রভাবিত করবে। বহু ভারতীয় পরিবার বলছে—“আমরা আর তাঁকে ভোট দিতে পারব না। আমাদের পরিচয়, নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ— সব কিছু নিয়ে খেলা করা হচ্ছে।”

এই ক্ষোভ ভোটের সমীকরণেও ধরা পড়ছে। আমেরিকায় প্রায় ৫০ লক্ষ ভারতীয়-আমেরিকান বাস করেন—টেক্সাস, নিউ জার্সি, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, অ্যারিজ়োনা— এ সব ‘সুইং স্টেট’ বা দোদুল্যমান প্রদেশে এঁদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালে ভারতীয়দের একটি বড় অংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন। অনেকে বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ভারতীয়দের জন্য উপকারী হবে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বিপরীত। অভিবাসন, শুল্ক, পরিবার— সব ক্ষেত্রেই ভারতীয়েরা এখন ট্রাম্পের উপরে অসন্তুষ্ট।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই মনোভাব শুধু ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে নয়, এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা অন্যান্যদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের পুরনো ভোট-ব্যাঙ্কের ভিত আর সুইং স্টেটসের বদলে যাওয়া মনোভাব রিপাবলিকানদের সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপরে সরাসরি চাপ ফেলতে পারে। ফলে, প্রেসিডেন্টের ‘থার্ড ওয়ার্ল্ড’ প্রসঙ্গ শুধু কূটনৈতিক বা মানবাধিকার বিতর্ক নয়— এটি ক্রমশ হয়ে উঠছে আসন্ন মিডটার্ম নির্বাচনের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।

আরও পড়ুন