vijaya dashami

বিজয়ার গুটিকয় চিঠি লেখার অভ্যাসই অগুনতি প্রেমের চিঠি লিখিয়ে নিয়েছে

নিজেদের বাড়ি থেকে আনন্দের এই ঢল ছড়িয়ে পড়ত আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের বাড়িতে।

Advertisement

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৯ ১২:৫৭
Share:

যে কোনও ধর্মীয় উৎসবের আসল উদ্দেশ্য হল মানুষে-মানুষে ভালবাসা বাড়ানো, যোগাযোগ বাড়ানো। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজোতেও তাই সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। ভালবাসার এই ছড়িয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ত বিজয়া দশমীর দিনে। এ দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পর থেকেই প্রণাম, কোলাকুলি এবং মিষ্টিমুখের পর্ব শুরু হয়ে যেত। সারা বছর নিজেদের মধ্যে যত ভুল বোঝাবুঝি বা মন কষাকষি তৈরি হোক না কেন, এই দিনটায় সব কিছু ভুলে ছোটরা বড়োদের প্রণাম করত আর বড়রা তাদের বুকে টেনে নিয়ে কোলাকুলি করে সব গোলমাল মিটিয়ে নিতেন। সত্যি, এখনকার এই চিরকালের মতো মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাওয়ার দিনে, আগেকার এই সুন্দর রীতিটিকে কোনও ভাবে যদি বাঁচিয়ে রাখা যেত, তবে আমাদের এই অসহিষ্ণু সমাজের ছবিটা হয়ত অনেকটাই পাল্টে যেত।

Advertisement

আটের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত আমরা দেখেছি বিজয়ার দিন সকাল থেকেই গেরস্ত বাড়িতে নাড়ু, নিমকি, ঘুগনি বানানোর ধুম লেগে যেত। সন্ধেবেলায় একটি লালরঙের খেরোর খাতায়, লাল কালির পেন দিয়ে ‘শ্রীশ্রীদুর্গাসহায়’ কথাটি মোট বারো বার লিখতে হত। এর পর ‘তারা’ হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষদের মালা পরানো ছবিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে, বাড়ির গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তার পর হত কোলাকুলি। আমাদের মতো অনেক পুরনো বাড়িতেই কোলাকুলির আগে এবং পরে প্রণাম করার রীতি ছিল। এর পর নিজেদের বাড়ি থেকে আনন্দের এই ঢল ছড়িয়ে পড়ত আত্মীয়স্বজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের বাড়িতে।

আগে, বিজয়ার দিনে একটু ফাঁকা সময় পেলেই অনেকেই বিজয়ার চিঠি লিখে রাখতেন। প্রণাম এবং আশীর্বাদ পাঠাতেন দূরে থাকা আত্মীয়বন্ধুদের উদ্দেশে। আর এই চিঠিটি লেখা হত, পুজোর ঠিক আগে পোস্টাপিস থেকে গোছা করে কিনে আনা হলদেটে পোস্টকার্ড বা ফিকে নীলরঙা ইনল্যান্ড লেটারে। একাদশীর দিন সাতসকালে, হয় পোস্টাপিসে গিয়ে আর তা নইলে পাড়ার গোমড়ামুখো লালরঙা ডাকবাক্সে এই চিঠিটি ফেলে আসতে হত। আমাদের বাড়িতে বিজয়ার চিঠি আসা শুরু হয়ে যেত মোটামুটি লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনটি থেকে। এই সময় ডাকপিওন দাদারা পাড়ায় ঘন ঘন রাউন্ড দিতেন। চিঠি হাতে কোনও বাড়িতে ঢুকলে, সেখানে বিজয়ার মিষ্টি-জল খেয়ে, চাট্টি সুখ-দুঃখের গল্প করে তার পর বেরতেন। পুজোর বকশিশ তো তাঁদের পুজোর আগেই পাওয়া হয়ে যেত। আর এখন, না আছে সেই বিজয়ার চিঠি, না আছে পিওনদাদাদের সেই পুজোর বকশিশ।

Advertisement

আরও পড়ুন: পুজোর বৃষ্টিতে ভেজা পিঠ, মুখে অন্য এক নক্ষত্রের হাসি

আমার পরিষ্কার মনে আছে, ফি বছর জামসেদপুরে থাকা বড়মাসিমাকে লেখা মায়ের বিজয়ার চিঠির তলার দিকের কিছুটা জায়গায়, আমাকেও একটি প্রণামী-চিঠি লিখতে হত। পরীক্ষার খাতায় ‘পত্র লিখ’-র বাইরে সেটাই আমার প্রথম সত্যিকারের চিঠি লেখা। আমার ধারণা, ছেলেবেলায় বাঙালি নাবালকদের বিজয়ার চিঠি লেখার এই যে অভ্যেস— সেটাই পরের দিকে অগুনতি বাঙালি কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীকে নিরলসভাবে প্রেমের চিঠি লিখে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিজয়ার চিঠি, সে তো মেরেকেটে পাঁচ-সাতটা। কিন্তু প্রমের চিঠি সেখানে হেসেখেলে হাফ সেঞ্চুরি পার করে দিত।

ইদানীং বাড়ি গিয়ে বা চিঠি লিখে বিজয়ার শুভেচ্ছা তো আর কেউই জানায় না। জানায় মোবাইল ফোন মারফৎ— একটি মাত্র মেসেজের মাধ্যমে। তার মাধ্যমেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় থালাভর্তি মিষ্ঠির একটি চমৎকার ছবি। নীচে লেখা থাকে— ‘শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন!’ বাড়িতে হাতে তৈরি নাড়ু আর নিমকির জায়গা এখন সহজেই দখল করে নিয়েছে, কাচকাচ পলিথিনের প্যাকেটে সিল করা নারকেল নাড়ু আর নিমকি। কিন্তু তাতে কি আর মা-জেঠিমার হাতের ভালবাসার স্পর্শ পাওয়া যায়?

যায় না। আর এখন তো ফাস্ট ফুডের দাপটে এই সব সাবেক নাড়ু-নিমকি-ঘুগনির দল স্রেফ হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে কি, হাল আমলের ছেলেমেয়েদের কাছে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিজয়া করার ব্যাপারটা যেন বড়ই সেকেলে। আর ফিগার কনশাস বলে, তারা তো একদানা মিষ্টিও মুখে তুলতে চায় না। তেলে ভাজা লুচি বা নিমকির সঙ্গেও তাদের আড়ি। গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার বিষয়টিও তাদের পছন্দসই নয়। চাপে পড়ে প্রণাম করলেও তাদের হাত তাঁদের হাঁটুর নীচে যেন আর নামতেই চায় না। আর গুরুজনরাও তাদের ‘থাক থাক’ বলে প্রণাম থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। এই ভাবে মনে হয় প্রণাম করার রীতিটাই এক দিন হারিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া পুজোর ভোগের রান্না

আগেকার দিনের সঙ্গে এখনকার তুলনা করতে বসলে দেখা যাবে, প্রতিমার গড়ন, মণ্ডপের গড়ন, আলোকসজ্জা, বিসর্জনের শোভাযাত্রা— সব কিছুই অনেকখানি বদলে গিয়েছে। বিজয়ার দিন ভাসানের প্রসেশন দেখাটাও যেন একটা উৎসবের মতো ছিল। যে পথ ধরে ভাসানের শোভাযাত্রা যাবে, হাজার হাজার লোক সেই সব রাস্তার দু’পাশে অনেক রাত পর্যন্ত উৎসাহভরে দাঁড়িয়ে থাকত। বয়স্ক মানুষরা বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কাঠের টুল বা বেতের মোড়ায় বসে অপেক্ষা করছেন— এমন দৃশ্য তো হামেশাই চোখে পড়ত। আর এখন যা দিনকাল, তাতে গুটিকয় বাড়ির পুজো ছাড়া বেশির ভাগ সর্বজনীন পুজোর প্রতিমাই দ্বাদশী বা ত্রয়োদশীর আগে ভাসানে যায় না। বাঙালি কিন্তু আজও সেই সব প্রশেসন আগ্রহ নিয়ে দেখে। লরির ওপর মা দুগ্গার মিষ্টি-গোঁজা মুখটির দিকে তাকিয়ে আজও সে মনে মনে বলে, ‘আসছে বছর আবার এসো মা!’ প্রতীক্ষা করে আগামী বছরের ওই আনন্দময় দিনগুলোর জন্যে, যাদের কথা মনে করে সামনের একটা বছর কোনও মতে কষ্টেশিষ্টে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

কার্টুন: দেবাশীষ দেব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন