—প্রতীকী ছবি।
সময়টা বড়ই অদ্ভুত। তার চেয়েও অদ্ভুত মানুষের মনোজগত্। যে তরুণ ভোটারেরা ২০০৮ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে নির্বাচনী ইশতেহারকে ধারণ করে নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন, যাঁরা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে নতুন ইতিহাস রচনা করেছিলেন, অল্প হলেও সেই তরুণদের একাংশকে নিয়েই এখন আশঙ্কা বাংলাদেশ জুড়ে। ক’দিন আগেও যেখানে সবার নজর ছিল মাদ্রাসা বা নিম্নবিত্ত পরিবারের দিকে, সেই নজরটি এখন দেশের দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেও। যে ছেলেটি দেশের নামকরা প্রতিযোগিতা ক্লোজআপ ওয়ানে ছিল- সেই এখন কালো পোশাকে হুমকি দিচ্ছে। যে অভিভাবক ক’দিন আগেও সন্তানকে মোটা পকেটমানি দিয়ে আনন্দে ছিলেন, তাঁরও মুখে আশঙ্কার মেঘ। সেই ভয়টার ভাল দিক হল সাবধান হয়ে উঠছেন অভিভাবকরা। সাবধান হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। আবার আর একটি বিষয়ও ভাবনার। তা হল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানেই কি জঙ্গি বানানোর যন্তর মন্তর ঘর? ১৮ থেকে ২৫ মানেই কি ভয়? না। অবশ্যই না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন তাদের অফিসিয়াল পেজে ২৬১ জনের একটি নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকার অধিকাংশ শুধু তরুণ নন, এতে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, সঙ্গীত শিল্পী, পোশাক শ্রমিক, রাজমিস্ত্রী ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী-সহ অন্তত ৯টি পেশার মানুষের খোঁজ মিলছে। বয়স ১৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে প্রায় সবার। এই তালিকার সবাই কি জঙ্গি? র্যাব এখনও নিশ্চিত নয়। তবে এই তালিকা জঙ্গি খোঁজার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র- তা নিয়ে সন্দেহ নেই কারও।
আরও পড়ুন: বেপাত্তা ২৬০, ছেলেধরার খোঁজে বাংলাদেশ পুলিশ
অন্যদিকে র্যাবের দেওয়া ২৬১ নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকায় ২৬১তম নামটি জিলানি ওরফে আবু জান্দালের, সে সিরিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। আইএস-এর পত্রিকা দাবিক দাবি করেছে- সে (জিলানী) আবু জান্দাল আল বাঙালি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে এই তালিকার মধ্যে ঢাকা থেকেই নিখোঁজ ৭২ জন। ঢাকার মহম্মদপুর, ধানমণ্ডি, আদাবর, উত্তরা, বনানী, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, রমনা, শেরে বাংলা নগর, তেজাগাঁও ও শ্যামপুর থেকে নিখোঁজ হয়েছে তারা। এছাড়াও কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া থেকেও নিখোঁজ হয়েছে কেউ কেউ।
গুলশানে হামলার পর প্রথম যে ১০ ব্যক্তির নিখোঁজ তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে একজন ধর্মান্তরিত অধ্যাপকও রয়েছেন। মহম্মদ সইফুল্লাহ ওজাকির আগের নাম ছিল সুজিত দেবনাথ। সিলেট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এই সুজিত জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেখানে উচ্চ শিক্ষা শেষ করেন। জাপানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সেখানের এক নাগরিককে বিয়ে করেন। এর পর বাংলাদেশে ফিরলেও গত এক বছর ধরেই সব যোগাযোগ ছিন্ন করে বেপাত্তা। জানা গেছে, মাস ছয়েক আগে কানাডা থেকে ওজাকি ওরফে সুজিত শেষবার কথা বলেছিলেন তার এক বন্ধুর সঙ্গে। এর পর তার সঙ্গে আর কারও যোগাযোগ হয়নি।
রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় নিহত জঙ্গিদের রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। রক্তের এই নমুনা পাঠানো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর কাছে। বুধবার সকালে ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ বলেছেন, ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল- সিএমএইচ-এ থাকা নিহত জঙ্গিদের রক্ত ও মাথার চুল সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআইয়ের কাছে পাঠানো হবে। সোহেল মাহমুদ বলেন, হত্যার আগে জঙ্গিরা শক্তিবর্ধক কিছু খেয়েছিল কি না কিংবা কোনও মাদক সেবন করেছিল কি না সেটাও পরীক্ষা করা হবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের সবটুকু শক্তি নিয়েই মোকাবিলায় নেমেছে জঙ্গিদের। পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান-সহ অন্য সবগুলো সংস্থাই তাদের তৎপরতায় আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধান অশ্বস্ত করছেন নাগরিকদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন এই জঙ্গিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলার। আর সেই কার্যক্রমও চোখে পড়ছে। অন্য দিকে, প্রথমে ব্লগার, পুরোহিত, যাজক বা পির হত্যাকান্ডের সময়ের চেয়ে দেশের চিত্রটি এখন ভিন্ন। জেলা, উপজেলা, থানা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রতিদিনই জঙ্গি বিরোধী মিছিল সমাবেশ অব্যাহত আছে। আওয়ামি লিগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল তৃণমূল স্তর পর্যন্ত প্রতিদিন কর্মসূচি নিচ্ছে। বামপন্থী সংগঠনগুলোর ক্ষমতা ক্রমেই সীমিত হলেও তারাও আছে সাধ্য মতো রাজপথে। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপির নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছে, সরকারকে জাতীয় ঐক্যের জন্য বলছে। কিন্তু সেই বিষয়ে সরকারি দল আওয়ামি লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, “সরকার পতনে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন ও পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যার পর, গুপ্ত হত্যা ও জঙ্গি হামলায়ও বিএনপি জোটের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ করছে দেশের জনগণ। নিজ দল ও জোটের সন্ত্রাসীদের রক্ষা করতেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।” অন্যদিকে বিএনপি প্রেস ব্রিফিং নিয়ে যতটা তৎপর, মাঠে তাদের তেমন উল্লেখ করার মতো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের অবস্থান নিয়ে সাধারণের মধ্যেও রয়েছে প্রশ্ন।