কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের মন্দির। নিজস্ব চিত্র।
আগ্রহ কিন্তু বিগ্রহ বা ফুলে নয়। মানুষ আর বইয়ে।
মন্দিরের ভেতর হৈ হৈ ভিড়ে পুস্তক প্রবাহ, খেই হারানোর অবস্থা। কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের অপ্রতিম নির্মাণ। আলাদা ভাবনা। অকৃত্রিম বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের স্মারক। বুঝিয়ে দেওয়া, সংস্কৃতি বাঙালির ছায়াসঙ্গী। যেখানে যাবে সেখানেই থাকবে। ইতিহাস বাদ দিয়ে আধুনিক হওয়া নয়। অতীতের গর্ভেই তো বর্তমান। ১৭০৪-এ দিনাজপুরে মাথা তুলতে শুরু করেছিল কান্ত জিউর মন্দির। সম্পূর্ণ হয়েছিল ৪৮ বছরে। ১৬৩১-এ তাজমহল গড়তেও এত সময় লাগেনি। ১৭৫২-তে মন্দিরটি পরিপূর্ণ হতেই অপার বিস্ময়। দামি পাথরে নয়, পোড়া মাটিতেই কেল্লাফতে। যারা করেছে তারা বাঙালি। আর্থিক সামর্থ্যে দুর্বল, প্রতিভায় বিরল। টেরাকোটার আখরে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প। মহাকাব্যের চরিত্রদের জীবন্ত রূপ।
বাংলার সময়টা তখন ভাল নয়। প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর পৌত্র মোহম্মদ আজিম-আল-দীনকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেছেন। সমস্যা সামলাতে পারছেন না তিনি। নিজেও ডুবছেন, বাংলাকেও ডোবাচ্ছেন। আর্থিক অনটন সামাল দিতে না পেরে কলকাতা, গোবিন্দপুর, সুতানুটি মৌজার মালিকানা মাত্র ১৬ হাজার টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতও
দিনাজপুরের মন্দিরের খবর রাখতেন আজিম-আল-দীন। শাহজাহানের তাজমহল তাঁকে শিল্প ভাস্কর্যের দিকে টেনেছিল। টেরাকোটা কাজের এমন নৈপুণ্য আগে দেখেননি। শিল্পকর্মে যাতে ব্যাঘাত না হয় সে দিকে তিনি সতর্ক ছিলেন। ইংরেজরা শহর নিয়েই ব্যস্ত। যে হেতু তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য, গ্রাম-মফস্বলের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি।
সংকট কালে দাঁড়িয়েও সে দিন বাঙালি শিল্পী-ভাস্বররা তুলে ধরেছিল তাদের সীমাহীন শিল্পকর্ম। যার গরিমা ৩০০ বছরেও এতটুকু ম্লান হয়নি। ইতিহাস খুঁড়ে তাকেই টেনে তুললেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪১তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় উপহার দিলেন বাঙালিকে। সেই অপরূপ মন্দির দেখে বিস্মিত নতুন প্রজন্ম। ভেবেছে, বাঙালির এমন ঐশ্বর্য অগোচরে ছিল কী ভাবে? হাসিনা দিনাজপুরের অবিস্মরণীয় মন্দির সামনে এনে একের পর এক তাৎপর্য তুলে ধরলেন। মন্দিরটি যখন তৈরি হয় ভারত বা বাংলা কোনওটাই ভাগ হয়নি। বাংলা সংস্কৃতি আজও যে অবিভক্ত তার প্রমাণ দিলেন। বাংলাদেশ কোনও একটি ধর্মের দেশ নয়, সব ধর্মের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ। মৌলবাদীদের আস্ফালনের এর চেয়ে বড় জবাব আর কী হতে পারে। সাম্প্রদায়িকতায় ভর করে তারা যখন সন্ত্রাস ছড়াতে চাইছে হাসিনার জবাব হিংসায় নয় প্রেমে। বিভেদ নয় সংহতি। মন্দিরের দৌলতে তিনি মিলিয়ে দিলেন বাঙালিকে। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আলাদা রইল না। একই সঙ্গে বাংলার অতীত ঐশ্বর্যের অংশীদার হয়ে গেল সমকালের বাঙালিরা।
মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা অস্ত্রে নয় সংস্কৃতিতে। তার পরেও কী বাঙালির গায়ে আঁচড় কাটার সাহস হবে সন্ত্রাসীদের। মন্দিরের গর্ভে বাংলাদেশের বইয়ের পাহাড়ে, পছন্দের বই আবিষ্কারেও পুলক কম নয়। ৩১টি স্টলে অপূর্ব পুস্তক সম্ভার। লোকে দেখছে আর কিনছে। ইচ্ছে থাকলেও যারা কিনতে পারছে না, তাদের জন্য কষ্ট। দুর্মূল্য বইয়ের নাগাল পাওয়ার প্রাণপন চেষ্টা একটা কারণেই, বই যে অমূল্য। তার বিকল্প কোথায়।