সাহায্যের অপেক্ষায়। ছবি: এএফপি।
নাফ নদ পেরোলেই মায়ানমারের নিপীড়ন থেকে মুক্তি। নিরাপদ আশ্রয় বাংলাদেশে। রাতের অন্ধকারে জলে ভাসা। উপকূল রক্ষীরা যেন দেখতে না পায়। মাঝ দরিয়ায় নৌকাডুবির ভয়। ভাগ্য ভাল না হলে বাঁচার বদলে চোরাস্রোতে সলিল সমাধি। সব হারিয়ে কক্সবাজারে টেকনাফের তীরে উঠলে প্রত্যুষের প্রত্যাশা। হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী মায়ানমারের মায়া কাটিয়ে মরণ-বাঁচন অভিযানে। নৌকায় তুলে দিয়েই দালালরা নেয় ৩০ হাজার টাকা। সেটাই নৌকা পিছু রেট। বাংলাদেশে পা রাখলে দালালদের দিতে হয় প্রত্যেককে দু'হাজার। কোলের শিশুরও ছাড় নেই। ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। ডাঙায় উঠেও শরণার্থীরা ভাবে বাংলাদেশ ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তো। দিলে যাবে কোথায়। মায়ানমারে যা ছিল সবই তো গেছে। ফৌজিরা ঘর পুড়িয়েছে। মেয়েদের ইজ্জত লুটেছে। মাটিতে পা রাখার এক ইঞ্চি জমিও অবশিষ্ট রাখেনি।
বৌদ্ধ প্রধান দেশে রোহিঙ্গারা বিধর্মী। এটাই কী তাদের অপরাধ। দুষ্কৃতীর অপবাদে দেশ ছাড়া করার চক্রান্ত। নতুন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবদান কি এটাই! সাম্প্রদায়িকতা-সৌভ্রাতৃত্ব তেল জলের মতো মিশ খায় না। ঘৃণার আগুন জ্বেলে সভ্যতাকে ধ্বংস করে। ১৯৯১-তে সামরিক শাসনে যা হয়েছে এখন তা হবে কেন! ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সভানেত্রী আউং সান সু চি দীর্ঘ সংগ্রামের পর দেশকে সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সাংবিধানিক কারণে তিনি শীর্ষ সরকারি পদ পাননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তাহলেও মায়ানমারের মুখ এখন তিনি। ২০১২ থেকে রাজনৈতিক সংস্কার শুরু। বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী সঙ্গে আলোচনার সূচনা তখনই। মানবাধিকার রক্ষায় আইন রচিত। গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। তার পরেও এই অমানবিকতা কেন।
১৯৮৯-তে বর্মা নাম পাল্টে মায়ানমার। বর্মা ভারতের সঙ্গে ছিল ১৯৩৭ পর্যন্ত। বাঙালি সেখানে কম ছিল না, এখনও আছে। কর্মসংস্থানে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বর্মা বাস দীর্ঘদিনের। তাঁর 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের অভয়ার আবির্ভাব বর্মাগামী জাহাজে। চরিত্রের দৃঢ়তায় অভয়া অতিক্রম করেছে রাজলক্ষ্মী, কমললতাকে। সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, 'শরৎচন্দ্রের গ্রন্থমধ্যে সমাজ ও ধর্মসংস্কারের হীন দাসত্বের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক বিদ্রোহ চলিয়াছে, অভয়া তাহার নেতৃবৃন্দের মধ্যে পুরোবর্তিনী।' বর্মা না গেলে শরৎচন্দ্র অভয়াকে পেতেন কোথায়। বর্মামুখী সমুদ্রযাত্রায় তিনি যেন অন্য মানুষ। প্রকৃতি বর্ণনা, কবিত্ব, জীবন সমালোচনা, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আগে বা পরে তাঁর কোনও লেখাতেই ধরা পড়েনি। শরৎচন্দ্রের বর্মা অভিজ্ঞতা শতাব্দী প্রাচীন হলেও দেশটার মৌলিক চরিত্র কী বদলাতে পারে। বরং আন্দোলনের পরোতে পরোতে বর্মা বিকশিত পদ্মফুলের মতো। ১৯৩০-এ বৌদ্ধ পুরোহিত সায়া সানের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ। ছাত্রদের 'অল বর্মা স্টুডেন্টস ইউনিয়ন' গঠন।
১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি বর্মা স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫০ সালে বর্মার প্রধানমন্ত্রী উন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো, মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শরিক। বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের ভূমিকা। ১৯৬২ থেকে ২৬ বছর জেনারেল নে উইনের সামরিক শাসনেও গণতন্ত্রের ভিত নড়েনি। ১৯৯৭-এর জুলাইতে 'আসিয়ান'এর সদস্য মায়ানমার। সে বছরই 'বিস্টেক' এর সদস্য। তারা যোগ দেওয়ায় মায়ানমারের 'এম' যুক্ত হয়ে বিস্টেক হয় 'বিমস্টেক'। সদস্য চার থেকে বেড়ে পাঁচ। বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড। ১৬ অক্টোবর গোয়ায় শীর্ষ সম্মেলনে নতুন করে তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সে সব কথা এখন নির্মম ব্যঙ্গের মতো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।