‘পথের পাঁচালী’ প্রতিবারই একটা নতুন কবিতা হয়ে ওঠে

শুধু কি কবিতার ব্যবহার? নাটকও তো আমাদের অনেক কিছু শেখায়। আবৃত্তির ক্লাসরুমে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়আগের সংখ্যায় আবৃত্তির প্রতিবেশী শিল্পগুলো—সঞ্চালনা, সংবাদপাঠ, শ্রুতিনাটক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম আমরা। এর বাইরে যে সব শিল্প আছে, যেমন নাটক, নাচ, গান, যন্ত্রসঙ্গীত—এগুলোর সঙ্গেও কি আবৃত্তিশিল্পের যোগ আছে? একজন আবৃত্তিকারের কি নাটক দেখা জরুরি? কিংবা গান শোনা? বা ছবি দেখা? বই পড়া?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:১২
Share:

আগের সংখ্যায় আবৃত্তির প্রতিবেশী শিল্পগুলো—সঞ্চালনা, সংবাদপাঠ, শ্রুতিনাটক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম আমরা। এর বাইরে যে সব শিল্প আছে, যেমন নাটক, নাচ, গান, যন্ত্রসঙ্গীত—এগুলোর সঙ্গেও কি আবৃত্তিশিল্পের যোগ আছে? একজন আবৃত্তিকারের কি নাটক দেখা জরুরি? কিংবা গান শোনা? বা ছবি দেখা? বই পড়া?

Advertisement

আপাতভাবে আবৃত্তির সঙ্গে এই সব শিল্পের বিশেষ যোগ নেই। কোনও আবৃত্তিকার যদি মঞ্চে এই শিল্পমাধ্যমগুলো ব্যবহার না করেন, তাহলে আপাতভাবে এই শিল্পগুলো না জানলেও চলে। কিন্তু সত্যিই কি চলে? আলোচনায় যাবার আগে একটা প্রশ্ন করি। একজন মানুষ তো একটা স্বতন্ত্র সত্তা। কিম্তু মানুষ কি একা থাকতে পারে? এমনকী, শুধু নিজের পেশার মানুষদের নিয়েও থাকতে পারে? যতই স্বতন্ত্র হোক, সমাজের অনেকগুলো বিন্দুকে ছুঁয়েই তাকে থাকতে হয়। একটা শিল্পও তাই যতই স্বতন্ত্র মাধ্যম হোক, প্রতিটা শিল্পই পরস্পরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে। তাই একটি শিল্পের সম্পূর্ণতার জন্য অন্য শিল্পগুলোকে জানতেই হয়।

আমার ছোটবেলায় দেখা দুটো নাটকের কথা মনে পড়ছে। একটি ‘চার অধ্যায়’। ‘‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/ তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’’— এই পঙক্তিগুলি কী অদ্ভুত আবেগে উঠে এসেছিল শম্ভু মিত্রের গলায়। প্রতিটি শব্দের নির্যাসকে একেবারে ভেতর থেকে বার করে নিয়েছিলেন তিনি। আজও আমি শুনতে পাই সেই উচ্চারণ। অন্য যে নাটকটার কথা বলতে চাই, সেটা ‘তিন পয়সার পালা’। ‘ঝুলন’ কবিতাটি ব্যবহার করা হয়েছিল সেই নাটকে। সহজ, অনায়াস, মর্মস্পর্শী সেই আবৃত্তি। যখন আমি কবিতাটি মঞ্চে বলব, আমি হয়তো ও ভাবে বলব না। কিন্তু কবিতাটি যে ও ভাবেও বলা যায়, ভাবা যায়! সেটা আমি দেখেছিলাম।

Advertisement

সাম্প্রতিক নাটকের মধ্যে মনে পড়ছে ‘হৃদমাঝারে’ নাটকটির কথা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন ‘‘ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে’— একটি নাটকীয় ভঙ্গিমায় আবৃত্তি করা হয়েছিল। কিংবা ‘ভাল রাক্ষসের গল্প’ নাটকে শঙ্খ ঘোষের ‘ও আমার মেঘলা আকাশ’। এই কবিতাটিতে একটা সুন্দর ছন্দ আছে। নাটকে ছন্দটাকে ভেঙে দিয়ে এক তীব্র আর্তিতে বলা হয়েছিল কবিতাটি। এক শুকনো জনহীন দেশের হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছিল সারা প্রেক্ষাগৃহে। কবিতাটি আমি মঞ্চে বলার সময় ছন্দ বজায় রেখেই বলব। কিন্তু কবিতাটিকে অমন হাহাকারের মতো শুনিনি কখনও।

শুধু কি কবিতার ব্যবহার? নাটক তো আমাদের আরও অনেক কিছু শেখায়। মঞ্চবিন্যাস, দলগত কাজ, আলোকসম্পাত, ধ্বনি— এগুলো খুব ভাল শেখা যায় নাটক থেকে। শুধু প্রায়োগিক দিক নয়, সব মিলিয়ে আমাদের অনুভূতিগুলোই যেন ধারালো হয়ে যায়।

‘পথের পাঁচালী’র কথা ভুলতে পারি না আজও। যত বার দেখি তত বারই যেন ছবিটা আমার কাছে একটা নতুন কবিতা হয়ে ওঠে। আবার উল্টোটাও হয়। ‘লিপিকা’ পড়তে পড়তে চোখের সামনে আঁকা হয়ে যায় পায়ে চলার পথ, দরজার পাশে ফুটে থাকা সূর্যমুখী কিংবা সুয়োরানির সাধের খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত।

কিছু দিন আগে আমি একটা বই পড়ছিলাম। আরভিং স্টোনের লেখা ‘লাস্ট ফর লাইফ’। ভ্যান গগের জীবনী। বইটা যখন পড়তাম, আমার চারপাশ থেকে মিলিয়ে যেত কলকাতা। আমি চলে যেতাম ঊনিশ শতকের ইউরোপে—নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স। বইটা পড়তে পড়তে বুঝেছিলাম শিল্পীর নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, যন্ত্রণা। তাঁর আনন্দ, তাঁর একাগ্রতাও। আমি ছুঁয়েছিলাম তাঁর সৃষ্টির মুহূর্ত। খুব সম্প্রতি পড়া বলে এই বইটির উল্লেখ করলাম। এ রকম আরও অনেক বই-ই আমাদের ভাবায়। নতুন করে ভাবতে শেখায়।

ঠিক একই ভাবে ভাবতে শেখায় ছবি, নাচ, গান বা অন্য যে কোনও চারুকলা। আসলে সাধারণ জিনিস—যা আমরা রোজ দেখি, সেগুলোই শিল্পীরা দেখেন অন্য ভাবে। সেই অন্য ভাবে ভাবার কাজটাকেই সমৃদ্ধ করে আমাদের শিল্পচেতনা।

এর অন্য একটা দিকও আছে। ধরুন, আমরা একটা কাজ করতে চাইছি দেশভাগের কবিতা নিয়ে। কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমাদের জানা থাকে এ বিষয়ে অন্য শিল্পমাধ্যমে কেমন কাজ হয়েছে, অন্যেরা এ বিষয়ে কী ভেবেছেন, তা হলে সব কিছু মিলিয়ে আমার একটা নতুন ভাবনা উঠে আসতে পারে। এবং সামগ্রিক ভাবে আমার বোধের জায়গাটি সমৃদ্ধ হবে। এর ছাপ আমাদের কাজে পড়বেই। এগুলোও মঞ্চে ওঠার প্রস্তুতি। নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা। আমরা যদি এই নিরন্তর প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে না যাই, তা হলে আমাদের এগোনোও থেমে যাবে।

সবচেয়ে বড় কথা, শিল্প মানে সুন্দরের সাধনা। যত ক্ষণ আমরা শিল্পের সাহচর্যে কাটাই—সেটা যে-শিল্পই হোক না কেন— তত ক্ষণ আমরা সুন্দরেরই সাধনা করি। সুন্দরের সেই সাধনা আমাদের আরও সংবেদনশীল করে। আমাদের জীবনবোধ, জীবনদর্শন তৈরি হয় নিজের মতো করে। এ ভাবেই আমরা যারা শিল্পচর্চা করি, শিল্পকে ভালবাসি— আমাদেরই কেউ কেউ কারিগর থেকে শিল্পী, আর শিল্পী থেকে রসস্রষ্টা হয়ে ওঠে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন