ঘোষণা আগেই ছিল। সেই অনুযায়ী সোমবার লোকসভায় দেউলিয়া বিল-২০১৫ পেশ করল কেন্দ্র।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের দাবি, সংসদে এই বিল পাশের পরে নতুন আইন তৈরি হলে, তা হবে সংস্কারের পথে একটি বড়সড় পদক্ষেপ। কারণ, তাতে মান্ধাতার আমলের দেউলিয়া ঘোষণার পদ্ধতি ঢেলে সাজা যাবে। এই প্রথম সব ধরনের সংস্থার জন্য একটিই দেউলিয়া আইন চালু হবে দেশে। ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সুযোগ আর সামনে খোলা না-থাকলে, ওই নতুন আইনের দৌলতে সংস্থা গোটানো এখনকার তুলনায় অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। সুবিধা হবে এ দেশে ব্যবসা শুরু করার জন্য বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে। ফলে লগ্নি বাড়বে। তার হাত ধরে গতি বাড়বে আর্থিক বৃদ্ধিরও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেষমেশ নতুন দেউলিয়া আইন চালু হলে, ধারের টাকা আদায় করা সহজ হবে ঋণদাতার পক্ষে। এখনকার তুলনায় বেশি নিশ্চিন্তে ধার দিতে পারবে ব্যাঙ্ক। সেই সঙ্গে ফুলে-ফেঁপে উঠবে ঋণপত্রের (কর্পোরেট বন্ড) বাজারও।
এ দিন লোকসভায় দেউলিয়া বিল (ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি কোড—২০১৫) পেশ করেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেখানে বলা হয়েছে, এখন যে দেউলিয়া আইন রয়েছে, তা প্রয়োজনের সাপেক্ষে যথেষ্ট কিংবা কার্যকরী নয়। ফলে অযথা বিলম্বিত হয় দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া। আর সেই কারণেই নতুন আইন তৈরির এই উদ্যোগ।
আর্থিক সঙ্কটের জেরে সময়ে ধার শোধ করতে সমস্যায় পড়া সংস্থা সম্পর্কে ছ’মাসের মধ্যে (১৮০ দিন) সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত খসড়ায়। খুব জটিলতা হলে, সেই সময়সীমা বাড়তে পারে বড়জোর ৯০ দিন। তেমনই আবার কোনও ক্ষেত্রে দ্রুত (ফাস্ট ট্র্যাক) সুরাহার প্রয়োজন হলে, তা করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে।
অর্থাৎ, ঋণের ভারে ধুঁকতে থাকা কোনও সংস্থা সময়ে তা শোধ দিতে না-পারলে, পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ১৮০ দিনের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে তাদের পক্ষে কী করণীয়। কিছু ক্ষেত্রে তা জানানো হবে ৯০ দিনের মধ্যে। দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাবে যে, ওই সংস্থাকে সত্যিই ফের ঘুরিয়ে দাঁড় করানো সম্ভব, না কি তার সম্পদ বিক্রি করে বরং তাড়াতাড়ি ধার শোধ করে দেওয়া হবে ঋণদাতাদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকলে, দ্রুত তা পাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। আবার তেমনই সেই আশা না-থাকলে, ধারের টাকা তাড়াতাড়ি ফেরত পাবে ঋণদাতারা। বেগতিক বুঝলে সংস্থার সম্পত্তি ধীরে ধীরে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটবে কম। ফলে সংস্থাগুলিকে ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি কমবে। তাতে সুবিধা হবে ব্যাঙ্কের। আবার একই সঙ্গে বহরে বাড়বে ঋণপত্রের (কর্পোরেট বন্ড) বাজারও। সব মিলিয়ে, কিছুটা সহজ হবে এ দেশে ব্যবসা করা।
বিলের খসড়া অনুযায়ী, দেউলিয়া ঘোষণা থেকে শুরু করে সংস্থার সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে ধার-দেনা মেটানো পর্যন্ত পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধানের জন্য গড়া হবে পর্ষদ (ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি বোর্ড অব ইন্ডিয়া)। এই ক্ষেত্রের পেশাদার, সংস্থা ইত্যাদি সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক হিসেবে। দেউলিয়া ঘোষণা সংক্রান্ত পুরো বিষয়টি মসৃণ করতে তৈরি করা হবে বিশেষ তহবিল।
এখন দেউলিয়া ঘোষণা নিয়ে অনেক মামলাই চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। আগামী দিনে সেই আইনি প্রক্রিয়াতেও গতি আনার বন্দোবস্ত করতে চায় কেন্দ্র। যাতে এই সংক্রান্ত ঝামেলা মেটানো যায় চট করে।
কোনও সংস্থা দেউলিয়া ঘোষণা করলে, তার সম্পদ বিক্রিবাটার টাকা কারা আগে বা পরে পাবে, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে বিলে। তেমনই কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি যদি দেউলিয়া ঘোষণার সুবিধা নিতে নিজের সম্পদ লুকোন বা সেই সম্পর্কে ভুল তথ্য দেন, তা হলে জরিমানা গুনতে হবে। হবে জেলও।
উল্লেখ্য, দেউলিয়া ঘোষণার পদ্ধতি ঢেলে সাজতে নতুন আইন তৈরির কথা গত বাজেটেই বলেছিলেন জেটলি। তার জন্য গত ৪ নভেম্বর খসড়া প্রস্তাব পেশ করে কেন্দ্র। ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত চেয়েছিল তারা। অর্থমন্ত্রী তখনই জানিয়েছিলেন, শীত অধিবেশনেই নতুন দেউলিয়া বিল তাঁরা সংসদে আনতে চান। জিএসটি নিয়ে ঐকমত্য তৈরির রাস্তা আপাতত ভেস্তে যাওয়ার পরে গত সপ্তাহে ফের সেই কথা জানায় কেন্দ্র। তার পরেই এ দিন লোকসভায় এই বিল পেশ।
এখন ভারতে দেউলিয়া ঘোষণার পদ্ধতি এক-এক ধরনের সংস্থার ক্ষেত্রে এক-এক রকম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে। এমনকী অনেক সময়ে কয়েক দশক আটকে থাকে আইনি জালে। তাতে অনেক সময়ে সমস্যা বাড়ে ধুঁকতে থাকা সংস্থার। আবার উল্টো দিকে, দেউলিয়া নিয়ে দীর্ঘ টালবাহানার জেরে শেষ পর্যন্ত মেরেকেটে হয়তো ধারের টাকার ২০% ফেরত পান ঋণদাতারা। নতুন দেউলিয়া আইন এই ছবি বদলাবে বলেই কেন্দ্রের দাবি।