সকালে সিইও, বিকেলে ড্রাইভার

স্যুট-টাইয়ের কর্পোরেট কর্তাকে বিমানবন্দরে নামিয়ে ঘড়িটা আড় চোখে দেখলেন গণেশ বালকৃষ্ণন। রাত সওয়া দু’টো। অ্যাপ-ট্যাক্সির ‘ডিউটি’ থেকে আজকের মতো ছুটি। কিন্তু মেরেকেটে ঘণ্টা চারেকের ঘুম জুটবে কপালে।

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:৫০
Share:

স্যুট-টাইয়ের কর্পোরেট কর্তাকে বিমানবন্দরে নামিয়ে ঘড়িটা আড় চোখে দেখলেন গণেশ বালকৃষ্ণন।

Advertisement

রাত সওয়া দু’টো।

অ্যাপ-ট্যাক্সির ‘ডিউটি’ থেকে আজকের মতো ছুটি। কিন্তু মেরেকেটে ঘণ্টা চারেকের ঘুম জুটবে কপালে। কাল মিটিং আছে তো! তাই সকাল হতে-না-হতেই বসতে হবে নিজের সংস্থার হিসেবের খাতায় (ব্যালান্স শিট) মুখ গুঁজে!

Advertisement

সবে নিজের সংস্থা গড়ার কাজে হাত দিয়েছেন বেঙ্গালুরুর বালকৃষ্ণন। ন’টা-সাতটার চাকরি সামলে কঠিন হচ্ছিল সেই স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করা। তাই মোটা মাস-মাইনের মায়া কাটিয়ে আপাতত ওলা-উবেরের মতো অ্যাপ-ট্যাক্সির চালকের আসনে। পেটের নয়, মনের খিদেই স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসিয়ে দিয়েছে আইআইটি-আইআইএমের এই প্রাক্তনীকে।

স্বপ্নের জ্বালানি জোগাড়ের জন্য একই রাস্তা বেছেছেন হায়দরাবাদের শ্রীনিবাস রাও, কলকাতার সুরজিৎ দাশগুপ্ত, শুদ্ধসত্ত্ব মিত্রের মতো অনেকে।

তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় বাঁধা গতের চাকরিতে হাঁপিয়ে ওঠা সুরজিৎবাবু খুঁজছিলেন নিজে ব্যবসা শুরুর সুযোগ। আবার ম্যানেজমেন্ট স্নাতক শুদ্ধসত্ত্ববাবু চেয়েছিলেন গান ও অভিনয়ের ইচ্ছের আগুন পাখিটাকে বুকের ভিতর বাঁচিয়ে রাখতে। দু’জনেরই দাবি, কর্পোরেট দুনিয়ার চাপ আর সময়ের অভাব সেই স্বপ্নকে দুরমুশ করতে বসেছিল। তাকে জিইয়ে রাখতেই অ্যাপ-ট্যাক্সির ব্যবসায় পা রাখা। বসে পড়া চালকের আসনে। রাও আবার স্টিয়ারিং ধরেছেন নিজের স্টার্ট-আপ সংস্থাকে দাঁড় করানোর সময় আর রসদ জোগাড়ের লক্ষ্যে।

খেলাধূলার জুতো-জামা তৈরির সংস্থা নাইকি-র প্রতিষ্ঠাতা ফিল নাইট এক সময় অডিট সংস্থার কাজ ছেড়েছিলেন ব্যবসাকে সময় দিতে না-পারায়। নিয়েছিলেন কম বেতনের কিন্তু কম সময়েরও কলেজে পড়ানোর চাকরি। নকরি ডট কম যাঁর হাতে তৈরি, সেই সঞ্জীব বিখচন্দানিও ব্যবসাকে সময় দিতে পাকা চাকরির বদলে করেছেন ‘পার্ট টাইম’ পড়ানোর কাজ। ভিন্‌ দেশে হোক বা এ দেশে— নিজের স্বপ্নকে সর্বস্ব পণ করে ধাওয়া করার পথে বরাবরই বাধা হয়েছে ন’টা-পাঁচটার চাকরি। একে চাকরির নিরাপত্তা, সামাজিক সম্মান, ভবিষ্যতে লাফিয়ে বেতন বাড়ার হাতছানি, এই সব কিছুকে কাঁচকলা দেখিয়ে শুধু মনের ডাকে সাড়া দেওয়া শক্ত। সে জন্য ছাতির মাপ লাগে অনেকখানি। তার উপর আমাদের মতো দেশে ভাল চাকরি ছেড়ে ‘ড্রাইভারের কাজ’! অনেকের কাছে বিষয়টি কল্পনাতেও আনা শক্ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে এঁরা সেই পথে পা বাড়ানোর ‘হিম্মত দেখিয়েছেন’, তাকে বদলে যাওয়া দেশের পাল্টে যাওয়া অর্থনীতির এক খণ্ড ছবি বলে ধরছেন অনেকে।

এঁদের চার জনেরই নামের পাশে ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি। সকলেই কাজ করেছেন বেসরকারি সংস্থায়। তাতে মাইনে মিলেছে। কিন্তু মনের খিদে মেটেনি। ফিনান্সে এমবিএ রাও হাত দিয়েছেন নিজের সংস্থা ‘মেড প্র্যাক্টিস ডট কম’ তৈরিতে। তার জন্য পুঁজি যেমন প্রয়োজন, তেমনই দরকার সময়ও। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক এবং বিমা সংস্থা টাটা-এআইজির প্রাক্তন ম্যানেজারের কথায়, ‘‘কর্পোরেট তা দিতে পারত না।’’ একই হাল স্টার্ট-আপ সংস্থা মোমোই-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বালাকৃষ্ণনেরও। দক্ষিণ কলকাতার নামী স্কুলের ছাত্র সুরজিৎবাবু আবার হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার চাকরিতে। অভিনয় ও গানের টানে ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়তে দ্বিধা করেননি শুদ্ধস্বত্তও। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় গান, অভিনয় সবই বন্ধ ছিল।’’ দমবন্ধ অবস্থা থেকে বেরোতেই অ্যাপ-ট্যাক্সির স্টিয়ারিং ধরেন এঁরা।

এর পিছনে অবশ্য কাজ করেছে অ্যাপ-ট্যাক্সির সময় আর রোজগারের সমীকরণও। এই ব্যবসায় লগ্নি বলতে গাড়ির দাম। প্রায় পাঁচ-ছ’লক্ষ টাকা। সময় আট ঘণ্টা, কিন্তু পছন্দ অনুযায়ী। যেমন রাও বলছেন, ‘‘নিজের সময়মতো আয়ের টানেই অ্যাপ-ক্যাব চালাই। দিনে সংস্থার কাজ। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে রাত আড়াইটে পর্যন্ত নিজের গাড়ি।’’

গাড়ি নিজের। মর্জি নিজের। অথচ রোজগার মন্দ নয়। অন্তত স্বপ্নের আগুন টিকিয়ে রাখতে জ্বালানি জোগানোর পক্ষে যথেষ্ট। গাড়ির সংখ্যার উপর নির্ভর করে মাসে ৩০-৬০ হাজার টাকা।

কিন্তু বাড়ি থেকে বাধা আসেনি? কেউ বলেননি, ‘‘শেষে ড্রাইভারি?’’

সুরজিৎবাবু বলছিলেন, ‘‘বাবা-মা আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আর যা-ই হোক, ‘ড্রাইভারি’ নয়।’’ তবে তাঁর দাবি, ‘‘এখন ছবি বদলেছে। বেতনের দ্বিগুণ আয় করছি।’’ শুদ্ধসত্ত্ববাবুর কথায়, ‘‘বাধা ছিল। কিন্তু মুম্বইয়ে অনুপম খেরের অভিনয় কর্মশালায় যোগ দিতে গিয়ে ওই শহরের কাজের ধারাই চোখ খুলে দিল।’’ তারপরই কলকাতায় ফিরে জমানো টাকা ও বাবার থেকে ধার নিয়ে অ্যাপ-ট্যাক্সির ব্যবসা।

উইন্ডস্ক্রিনে শুধু সামনের রাস্তা নয়, নির্ঘাৎ নিজের স্বপ্নও দেখতে পান বালকৃষ্ণনরা। তাই ঝুলিতে ডিগ্রি থাকতেও সওয়ারির খোঁচা দেওয়া কথা তেমন গায়ে লাগে না। গাড়িতে তেল ভরার মতোই মনের ট্যাঙ্ক ভরা থাকে সেই স্বপ্ন পূরণের ছটফটানির জ্বালানিতে। রাত জাগাও তাই কখন জানি গা-সওয়া হয়ে আসে।

নিরাপদ রাস্তা ছেড়ে ইচ্ছের পিছু ধাওয়া? সহজ নয়। ট্যাক্সি-চালকের আসনে বসতেও তা হলে কখনও-সখনও ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি লাগে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন