রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। —ফাইল চিত্র।
কর্ণের রথের চাকা কুরুক্ষেত্রে বসে গিয়েছিল এক ব্রাহ্মণের অভিশাপে। আর গত বছরে ভারতীয় অর্থনীতির চাকা মাটিতে গেঁথে যাওয়ার জন্য নোটবন্দি এবং তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর জোড়া ধাক্কাকে দায়ী করলেন রঘুরাম রাজন।
নোটবন্দির দু’বছর পূর্তিতে মোদী সরকার যখন তার সাফল্য জাহিরে ব্যস্ত, ঠিক তখনই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নরের অভিযোগ, আসলে ওই হঠকারী সিদ্ধান্তের সঙ্গে পণ্য-পরিষেবা কর চালুর তাড়াহুড়োই গত বছর ডুবিয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিকে। গোত্তা খেয়েছে বৃদ্ধির হার। তা-ও সেই সময়ে, যখন বাকি বিশ্বের অর্থনীতি মুখ তুলেছে অনায়াসে।
এই দু’য়ের মারাত্মক মিশেল যে দেশের অর্থনীতিকে এক ঝটকায় বহু ক্রোশ পিছিয়ে দিয়েছে, সেই অভিযোগ আগেই করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ভারতের অর্থনীতিতে নোট নাকচের গভীর ক্ষতের কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও। এ নিয়ে মোদী সরকারকে তীব্র কটাক্ষে বিঁধলেন আমেরিকায় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুলে অর্থনীতির অধ্যাপক রাজন।
নোট বাতিলে বৃদ্ধির হার ধাক্কা খাবে বলে যে সমস্ত ‘পণ্ডিত’ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, সম্প্রতি ব্লগে তাঁদের ফের কটাক্ষ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। যেন বলতে চেয়েছিলেন, এর পরেও তো বৃদ্ধি ৭ শতাংশের উপরে। আর চিনকে টপকে ভারতই বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় সেই যুক্তিকে কার্যত পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছেন রাজন। স্পষ্ট বলেছেন, ৭% বৃদ্ধিতে বুক বাজানোর দিন আর নেই। টানা ২৫ বছর ওই হারে বৃদ্ধি অবশ্যই প্রশংসার। কিন্তু এখন ওই হারই ভারতের নতুন ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’। অর্থাৎ, এই নিরিখে ন্যূনতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ফি মাসে যে সংখ্যক তরুণ-তরুণী এ দেশে চাকরির খোঁজে কাজের বাজারে পা রাখছেন, তাতে যথেষ্ট সংখ্যক কর্মসংস্থানের জন্য ৭% বৃদ্ধি আর আদৌ যথেষ্ট নয়।
শুধু বৃদ্ধির হার নয়, মোদী সরকারের অতি কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি রাজন। বলেছেন, সব প্রকল্পেই যদি প্রধানমন্ত্রীর সায়ের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়, তবে আর কাজ এগোয় কী করে? তিনি ১৮ ঘণ্টা কাজ করলেও তো আর সব দেখে ওঠা সম্ভব নয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জুড়ে দিয়েছেন, স্ট্যাচু প্রসঙ্গও।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সংসদে বলেছিলেন, নোট নাকচের জেরে অন্তত দুই শতাংশ বিন্দু গোত্তা খাবে বৃদ্ধির হার। আরও এক ধাপ এগিয়ে অমর্ত্য বলেছিলেন, অর্থনীতিতে নগদের জোগান কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে জিডিপি হয়তো বা বাড়বে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তের ফলে যে মানুষগুলো ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গেলেন, তাঁদের জীবন ফিরবে না। পূরণ হবে না প্রান্তিক চাষি, ছোট শিল্প ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি। এ দেশে মেয়েদের কাজের সুযোগ এমনিতেই কম। নগদের টানাটানিতে তা আরও মার খাবে। তাঁর মতে, জিডিপিকে ঠেলেঠুলে যদি বা তোলা যায়, এই সমস্ত ক্ষতি অপূরণীয়। পরবর্তী সময়ে তথ্যেই প্রতিফলিত যে, সেই কথা মিলে গিয়েছে অক্ষরে-অক্ষরে।
আবার নোটবন্দির সেই ক্ষত না শুকোতেই তড়িঘড়ি জিএসটি চালু নিয়ে মনমোহনের অভিযোগ ছিল, ৮৬% নোট ফিরিয়ে নেওয়ার পরে হুড়মুড়িয়ে জিএসটি চালু করা বৃদ্ধিকে ধাক্কা দিতে বাধ্য। কার্যত তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল রাজনের কথায়। নোট নাকচে ‘হ্যাঁ’ বলতে না চাওয়া যাঁর শীর্ষ ব্যাঙ্ক থেকে সরার কারণ বলে এখনও মনে করেন অনেকে।