মিশেল ওবামার ডিজাইনারের পোশাকও মাসিক কিস্তিতে

চাকরি জীবনে সবে পা রেখেছেন সোহিনী মিত্র। কাজ করছেন বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে। সামনেই দাদার বিয়ে। খোঁজ পড়ল ভিড়ের মাঝে আলাদা হওয়ার সাজের। নেট ঘাঁটতে গিয়ে চোখ আটকাল এমব্রয়ডারি করা সোনালি সিল্কের গাউনে। ডিজাইনার বিভু মহাপাত্র। যাঁর পোশাক ভীষণ পছন্দ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-ঘরণী মিশেল ওবামারও!

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৬ ০২:১৫
Share:

চাকরি জীবনে সবে পা রেখেছেন সোহিনী মিত্র। কাজ করছেন বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে। সামনেই দাদার বিয়ে। খোঁজ পড়ল ভিড়ের মাঝে আলাদা হওয়ার সাজের। নেট ঘাঁটতে গিয়ে চোখ আটকাল এমব্রয়ডারি করা সোনালি সিল্কের গাউনে। ডিজাইনার বিভু মহাপাত্র। যাঁর পোশাক ভীষণ পছন্দ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-ঘরণী মিশেল ওবামারও! গাউন যেমন নজরকাড়া, তেমনই চোখ কপালে তোলা দামও। প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। তবু দাদার বিয়েতে তা গায়ে চাপানো আটকায়নি সোহিনীর। সৌজন্যে রকএনশপ ডট কম থেকে তা কিনে ১২ মাস ধরে কিস্তিতে (ইএমআই) দাম মেটানোর সুবিধা।

Advertisement

মাসিক কিস্তি গুনে বাড়ি-গাড়ি-ফ্রিজ-টিভি-মোবাইল কেনার চল অনেক দিনের। সেই তালিকায় হালে যোগ হয়েছে ডিজাইনার পোশাক, বিলাস (লাক্সারি) পণ্যও। কিস্তির অস্ত্রেই সাধ ও সাধ্যের ফারাক ঘুচিয়ে অনেক সময় তা ঢুকে পড়ছে চাকরিজীবীর আলমারিতে। বিশেষত নতুন প্রজন্মের। যাদের একটা বড় অংশ বিলাস-পণ্য কিনতে মোটা টাকা খরচে পিছপা নয়। রাজি নয় তার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষাতেও।

এত দিন ফ্যাশন পত্রিকার পাতা বা ঝাঁ-চকচকে শো-রুমে আটকে থাকা স্বপ্নকে এ ভাবে আলমারিতে পুরতে পারলে সোহিনীরা খুশি। তেমনই বাজার বাড়ায় ব্যবসার নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পাচ্ছেন ডিজাইনাররা। এই কাজে নেট-বাজারকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করছেন তাঁরা। বিপণন বিশেষজ্ঞ রাম রায় বলেন, ‘‘নতুন প্রজন্ম কোনও জিনিসের জন্য অপেক্ষা করতে চায় না। যা পছন্দ, তা তখনই কেনার তাগিদ থাকে। নেট-দুনিয়া ও ইএমআই সেই সুযোগই করে দিচ্ছে।’’

Advertisement

ডিজাইনার জামা-জুতো-ব্যাগ বিক্রির পোর্টাল রকএনশপ-এর কর্ণধার প্রিয়া সচদেবের দাবি, ‘‘কর্পোরেটে কাজ করা ২৫-৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ডিজাইনার জিনিস কেনার ইচ্ছে প্রবল। শখ মেটাতে কিস্তির হাত ধরছেন অনেকেই।’’ দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে এই প্রবণতা আগেই শুরু হয়েছে। এখন দৌড়ে সামিল কলকাতাও। সব মিলিয়ে নতুন বাজার খুলে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি বিলাস পণ্য বিক্রেতাদের সামনে।

আজকের কর্পোরেট-প্রজন্মকে তিরিশ না পেরোতেই হাতছানি দেয় লোই ভুতোঁ ব্যাগ, জিমি চু জুতো বা ভার্সাশে গাউন। তারা বিশ্বাস করে ওই সব বিলাসসামগ্রী শুধু ধনকুবেরদের নয়। এই মানসিকতা মেপেই নেট-বাজার ও কিস্তির জোড়া অস্ত্রে শান দিয়ে বাজার ধরতে ঝাঁপাচ্ছেন অনেকে।

অনলাইন বাজারের হাত ধরে ব্যবসা বাড়াতে চাইছেন রোহিত বাল, তরুণ তাহিলিয়ানি, সত্য পল, ঋতু কুমার, মণীশ মলহোত্রর মতো প্রথম সারির ডিজাইনাররা। আবার শুধু নেট-বাজারের ইএমআই সুবিধার উপর নির্ভর না করে নিজের বিপণিতে এই ব্যবস্থা চালু করেছেন অগ্নিমিত্রা পাল। হাওড়ায় অবনী শপিংমলে তাঁর বিপণিতে রেডিমেড পোশাক বিক্রি হয়। সেখানে কিস্তিতে দাম মেটানোর সুবিধা আছে। তার দৌলতে ৫-১০ হাজারের পোশাক অনায়াসে বিকিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘ডিজাইনার জিনিসের বাজার বাড়াতে সাহায্য করছে মাসিক কিস্তির এই সুযোগ।’’

সাধারণত বিলাস-পণ্যের বঁড়শিতে ক্রেতা টানার অন্যতম ‘ইউএসপি’ সকলের ঘরে তা না থাকা। সেখানে কিস্তির হাত ধরে যদি তা অনেকের আলমারিতে সেঁধিয়ে যায়, তাহলে সেই কদর আর থাকবে কি? কমে যাবে না ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’?

ডিজাইনারদের দাবি, ‘‘না’’। এর জন্য মূলত দু’টি যুক্তি দিচ্ছেন তাঁরা। প্রথমত, কিস্তিতে মিললেও সকলে অত টাকা খরচ করে ওই ধরনের পোশাক বা পণ্য কিনবেন না। কিনতে পারবেনও না। শখ এবং সাধ্যই এই বাজারকে ছোট করে দেবে অনেকখানি। আর দ্বিতীয়ত, এখানেও একটা শ্রেণি ভাগ থাকে। যেমন, ডিজাইনার পোশাককে ‘প্রেট’ ও ‘কুতুর’— এই দু’ভাগে ভাগ করা হয়। ‘প্রেট’ মূলত রেডিমেড বা তৈরি পোশাক। যার দাম কমের দিকে। আর ‘কুতুর’ বেশ দামি। অনলাইনে সাধারণত বিক্রি হয় প্রেট পোশাকই।

প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কিস্তির হাত ধরার পক্ষে সওয়াল করছেন অভিষেক দত্ত এবং ‘দেব আর নীল’ ব্র্যান্ডের নীলও। অভিষেকের দাবি, নেট-বাজারের সৌজন্যে বিদেশি ব্র্যান্ড এখন সহজলভ্য। কিস্তিতে বিক্রি করে বেশি সংখ্যক ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে আর্মানির মতো এক ডাকে চেনা ব্র্যান্ডও। গত বছর থেকে তাদের জিনস্ পাওয়া যাচ্ছে কিস্তিতে। দেশি ডিজাইনারদেরও একই পথে হাঁটতে অসুবিধা নেই বলে তাঁর ধারণা। ডিজাইনার জিনিস মানে তা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, এ কথা মানতে নারাজ নীলও। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্যাশন গণতান্ত্রিক।’’ তা ছাড়া, মেট্রো শহরের বাইরেও বিলাস-পণ্যের চাহিদা যে ভাবে বাড়ছে, সেই হাতছানি উপেক্ষা করা কঠিন হচ্ছে ডিজাইনারদের পক্ষে।

সব মিলিয়ে, এই বাজার বাড়ছে লাফিয়ে-লাফিয়ে। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে তা বাড়ছে ৩০% হারে। চলতি বছরে এই বাজারের মাপ ৮৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়ানোর সম্ভাবনা। এর টানে বিলাস-পণ্যে নজর দিচ্ছে অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, ই-বের মতো ই-কমার্স সংস্থা। মাসিক কিস্তির সুবিধা দিতে তারা গাঁটছড়া বাঁধছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থার সঙ্গে।

বিভু মহাপাত্র শুধু মিশেল ওবামার নন। সোহিনী মিত্রেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন