শেয়ার বাজার আছে, উত্তেজনা নেই এমনটা হয় না। কখনও আশায় ভর করে উত্তেজনা, কখনও বা আশঙ্কায়। গত সপ্তাহটা ছিল আশা-আশঙ্কার দোলায় ভরা। দেশ-বিদেশের নানা খবর এবং ঘটনা ভাল রকম প্রভাবিত করেছে সেনসেক্স ও নিফ্টিকে। ফলে ওঠা-পড়ায় উত্তাল ছিল সপ্তাহটা। এই উত্তেজনা চলতি সপ্তাহেও বহাল থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তার কারণগুলি এক লপ্তে দেখে নেওয়া যাক:
• ভারতে আর্থিক সংস্কার এ বার ডানা মেলে ওড়ার অপেক্ষায়। পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করার বিষয়টি তামিলনাড়ু বাদে বাকি সব রাজ্যের সম্মতি পেয়েছে। আশা, সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে জিএসটি বিল উতরে যেতে পারে। এটা হলে শেয়ার বাজারের কাছে পৌঁছবে সদর্থক বার্তা।
• উত্তেজনার উপকরণ আছে স্টেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে তার পাঁচটি সহযোগী ব্যাঙ্কের একত্রীকরণের প্রস্তাবেও। এই প্রস্তাব গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় সহযোগী ব্যাঙ্কগুলির শেয়ারের দর এরই মধ্যে ২০% পর্যন্ত বেড়েছে। আগামী দিনে তা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রস্তাবে ভর করে ২০০ টাকার সীমা পেরিয়ে কিছুটা এগিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের শেয়ারও। তবে এই সংযুক্তি ঘটলে সহযোগী ব্যাঙ্কগুলির শেয়ারহোল্ডাররা বেশি লাভবান হবেন বলে ধারণা। বুক ভ্যালুর তুলনায় এসবিআই শেয়ারের দাম যেখানে ০.৯ গুণ, সেখানে সহযোগী ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে এই অনুপাত ০.৬ গুণ। একত্রীকরণ সম্পূর্ণ হলে তৈরি হবে এক ‘দৈত্য ব্যাঙ্ক’। শাখার সংখ্যা হবে ২২,৫০০, এটিএম ৫৮,০০০টি। একত্রিত সম্পদের পরিমাণ পৌঁছে যেতে পারে ৩৭ লক্ষ কোটি টাকায়। বিশ্ব ব্যাঙ্কিং মানচিত্রে এসবিআই ৭ ধাপ উঠে পৌঁছে যেতে পারে ৪৫ নম্বরে। এই সংযুক্তি শেয়ার বাজারে ব্যাঙ্কিং সূচককে ঠেলে বেশ খানিকটা উপরে তুলবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
• সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে রঘুরাম রাজন জানিয়ে দিয়েছেন, অধ্যয়নের জগৎই তাঁর জন্য সঠিক জায়গা। অর্থাৎ দ্বিতীয় বারের জন্য তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্ণধার থাকতে চান না। সময়ই বলবে, ভারতের অর্থনীতির জন্য তাঁর এই সিদ্ধান্ত কতটা ভাল বা খারাপ। রাজন চলে গেলে কেন্দ্রের কাছে সুদ আরও কমানোর পথ প্রশস্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে খুচরো ও পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি সম্প্রতি বেড়ে ওঠায় এখনই সুদ কমার কোনও সম্ভাবনা নেই।
• বিশ্ব বাজার থেকে বড় আশঙ্কার বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে ‘ব্রেক্সিট’ অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ই ইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব। এই ব্যাপারে চলতি সপ্তাহে গণভোট নেওয়া হবে। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ভাল রকমের আঘাত আসতে পারে বিশ্ব বাজারে। ভারতের শেয়ার সূচকও ৫ থেকে ১০% পর্যন্ত পড়তে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।
• গত সপ্তাহে আশঙ্কার বার্তা এসেছিল জাপান থেকেও, যার জেরে দাম নেমেছিল মারুতি-সুজুকির মতো জাপান-নির্ভর সংস্থার শেয়ারে।
• মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ এখনও সুদ বাড়ায়নি। বাজারের জন্য এটি একটি ভাল খবর।
গোটা বাজার থেকে দৃষ্টি একটু ছোট করে এ বার বিশেষ বিশেষ শেয়ারের উপর নিবদ্ধ করা যাক। স্টেট ব্যাঙ্কের ব্যাপারে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এ বার তাকানো যাক রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের দিকে। আয়তনে বিপুল এই সংস্থা গত দু’বছর ধরে বাজারে যেন খুব নিষ্প্রভ। হাজার ছাড়িয়ে কিছুতেই উঠতে পারছে না। ভিতরে ভিতরে কিন্তু এই হেভিওয়েট কোম্পানি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বেড়ে উঠছে সম্পদের পরিমাণ। শেয়ার বাজার হয়তো আর বেশি দিন চোখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না হাতে ভাল রকম নগদ থাকা সংস্থাটির দিক থেকে। ২০১৫-’১৬ সালে মোট আয় কমলেও তার নিট লাভ ২০.৬৮% বেড়ে পৌঁছেছে ২৭,৪১৭ কোটি টাকায়। শেয়ার পিছু আয় বেড়ে হয়েছে ৮৪.৭০ টাকা। সংরক্ষিত তহবিল ২,৩৬,৯৩৬ কোটি টাকা। ১০ টাকার শেয়ারের বর্তমান বাজার দর ৯৭৪ টাকা। দীর্ঘ মেয়াদে এটি ভাল লগ্নির জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
সোনার দাম এখন তুঙ্গে। পাকা সোনা ৩০ হাজারের উপরে। হলমার্ক গয়নাও ৩০ হাজার ছুঁইছুঁই। মার্কিন ফেড রেট কমলে কিন্তু পড়তে পারে সোনার দাম। অর্থাৎ যাঁরা কম দামে লগ্নি করেছেন, তাঁরা সোনার খাঁচায় বন্দি না-থেকে মুক্ত হওয়ার কথা ভাবতে পারেন। যাঁরা গয়নার জন্য সোনা কেনার কথা ভাবছেন, তাঁরা প্ল্যাটিনামের দিকেও তাকাতে পারেন। দাম কিন্তু সোনার থেকে অনেকটাই কম। ১০ গ্রাম গয়নার সোনার দাম যখন ২৯,৫০০ টাকা, তখন ‘সাদা সোনা’ প্ল্যাটিনামের দাম ২৪ হাজার টাকার আশেপাশে। নতুন প্রজন্ম সোনা ছেড়ে কিছুটা প্ল্যাটিনামের দিকে ঝোঁকায় এবং সোনার তুলনায় দাম নেমে আসায় চাহিদা বাড়ছে প্ল্যাটিনামের। এই কারণে ২০১৪ সালে যেখানে প্ল্যাটিনাম আমদানি হয়েছিল ৫.৬ টন, সেখানে ২০১৫ সালে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭.২ টন। অন্য দিকে আমদানি কমছে সবার প্রিয় হলুদ ধাতুটির। এই পরিস্থিতিতে সোনা না প্ল্যাটিনাম, এই প্রশ্ন ভাবাবে অনেককেই।
নতুন নিয়মে জুলাই মাসে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলির সুদ বাজারের হারের ভিত্তিতে ফিরে দেখার কথা। যার ফল খুব সুখের না-ও হতে পারে। আশঙ্কা, এর ফলে কমতে পারে পিপিএফ এবং প্রবীণ নাগরিক সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ। নতুন নিয়ম অনুযায়ী পিপিএফ প্রকল্পের সুদ ১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ড ইল্ডের তুলনায় ২৫ বেসিস পয়েন্ট উপরে থাকার কথা। এই বন্ড-সুদ সম্প্রতি নেমে এসেছে ৭.৫ শতাংশের কাছে। তবে পিপিএফে সুদ কমালে মধ্যবিত্ত আবার চটবে। এই প্রকল্প নিয়ে অন্য ব্যাপারে দু’বার সিদ্ধান্ত ফেরানোর পরে সরকার এই ঝুঁকি নেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।