সব বাজারেরই অবস্থা এখন শীতের পাতাঝরা গাছগুলির মতো শীর্ণকায়। টাকা কম, ক্রেতা কম, চাহিদা কম। অনিশ্চয়তা চতুর্দিকে।
এই অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে শেয়ার বাজারকেও। গত ৮ নভেম্বর নোট বাতিল করার কথা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করার পরে সেনসেক্স নেমেছে কম-বেশি ১৫০০ পয়েন্ট। এর সরাসরি প্রতিফলন পড়েছে মিউচুয়াল ফান্ডের জগতে। চুপসে গিয়েছে বহু প্রকল্পের ন্যাভ। টাকার অভাবে সোনার বাজার থেকে শুরু করে সাধারণ পাইকারি এবং খুচরো বাজার সর্বত্রই ক্রেতার অভাব। ছন্নছাড়া অবস্থা সব বাজারেই।
হঠাৎ চতুর্দিকে চাহিদা চুপসে যাওয়ার প্রতিকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কৃষি এবং শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই। এর জেরে কমতে পারে কর্মসংস্থান। নামতে পারে জাতীয় আয় বা জিডিপি। ডলারের তুলনায় টাকার দামও কমছে হু-হু করে। এতে ধাক্কা খাবে আমদানি-নির্ভর শিল্প। বাড়বে সরকারের আমদানি বিল। ডিসেম্বরে মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভ যে সুদ বাড়াবে, তা এক রকম নিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতিতে ধাক্কা আসবে এই দিক থেকেও। মার্কিন মুলুকে সুদ বাড়লে বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলির অনেকেই প্রস্থান করতে পারে। এতে আরও চাপ আসবে ভারতীয় টাকা এবং শেয়ার সূচকের উপর।
ভারতে খুচরো এবং পাইকারি পণ্যমূল্য এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। টাকার জোগানে বড় রকমের ঘাটতি থাকায় জিনিসের দাম আগামী দিনে আরও নামবে। এই কথা মাথায় রেখে ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ কমানোর সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে। অনেকেরই অনুমান, এই দফায় সুদ ৫০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমানো হতে পারে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ কমানোর অপেক্ষায় বসে নেই। পরিস্থিতি বিচারে এরই মধ্যে জমা এবং ঋণে সুদ কমিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক। গত কয়েক দিনে ব্যাঙ্কগুলির স্ট্রং-রুমে জমে উঠেছে টাকার পাহাড়। এ পর্যন্ত বাতিল নোট জমা পড়েছে কম-বেশি ৪ লক্ষ কোটি টাকার। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা পড়তে পারে আরও ৬ থেকে ৮ লক্ষ কোটি টাকা। অন্য দিকে ব্যাঙ্ক থেকে নতুন নোট ছাড়া হচ্ছে কার্যত কড়া ‘রেশনিং’-এর মাধ্যমে। ব্যাঙ্কের ঘরে এত টাকা জমে ওঠায় তারা আর তেমন আমানত চাইছে না। ফলে কমাতে শুরু করেছে জমার উপর সুদ। অন্য দিকে জমে ওঠা টাকা দ্রুত ঋণ হিসেবে বণ্টনের তাগিদে সুদ কমানো হচ্ছে তার উপরেও। এরই মধ্যে বেশ কিছুটা সুদ কমানো হয়েছে বাড়ি ও গাড়িঋণের উপর। এই ভাবে আমরা কম সুদের জমানায় প্রবেশ করেছি। জমার উপর সুদ এরই মধ্যে ৭ শতাংশের মায়া কাটিয়ে নীচে নেমেছে। ভবিষ্যতে আরও নামার সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ এ বারের শীতে সুখনিদ্রা থেকে বঞ্চিত হবেন অসংখ্য সুদ-নির্ভর মানুষ।
একটু একটু করে গত কয়েক দিনে অনেকটাই দুর্বল হয়েছে শেয়ার বাজার। দেশে নোট বাতিল সংক্রান্ত সমস্যা এবং ফেড রেট বাড়ার সম্ভাবনা বেশ আতঙ্কে রেখেছে বাজারকে। অবস্থা কত দিনে শোধরাবে তার কোনও ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ছোট মেয়াদে বাজারে প্রাণ ফিরবে এমন আশা করা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু বড় মেয়াদের কথা ভাবলে বাজার নিয়ে আশা করার জায়গা আছে। এই বাজারকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। অবশ্যই বড় মেয়াদের জন্য। অনেক ভাল শেয়ারের দাম এখন চলে এসেছে নাগালের মধ্যে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে সবুরে মেওয়া ফলবে আশা করা যায়।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্য ভাল ধাক্কা খাবে প্রস্তাবিত নতুন ইস্যুগুলি। কেন্দ্রকেও নতুন করে ভাবতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিলগ্নিকরণ নিয়ে। সরকারের উপর গুরুদায়িত্ব, একসঙ্গে এত কিছু সামলানো। ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না।
নয়া কৌশল
• ঝুঁকে পড়া শেয়ার বাজার এবং সম্ভাবনাময় বন্ড বাজারে লগ্নি করুন ব্যালান্সড ফান্ডে
• সস্তায় ঝুলিতে পুরুন ভাল শেয়ার। নজর রাখুন ডিভিডেন্ড ইল্ডের উপর
• লগ্নি করতে পারেন ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ডেও
• ব্যাঙ্কে জমা করা বাতিল টাকা আগামী দিনে লগ্নি করতে পারেন লিকুইড ফান্ডে
• বড় মেয়াদে ব্যাঙ্কে বা গৃহঋণ সংস্থার আমানত প্রকল্পে টাকা রাখতে চাইলে, তা করুন সুদ আরও কমার আগে
• নগদ বাঁচাতে বেশি করে ব্যবহার করুন কার্ড এবং ই-ওয়ালেট
ব্যাঙ্কে সুদ কমতে থাকায় ন্যাভ বাড়ছে ঋণপত্র-নির্ভর প্রকল্পগুলির। অন্য দিকে অনেকটাই দাম পড়েছে ইকুইটির। এই পরিস্থিতিতে ব্যালান্সড ফান্ডে লগ্নি করা লাভজনক হতে পারে। ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যদি রেপো রেট কমায়, তবে জানুয়ারিতে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে আরও এক দফা সুদ কমতে পারে। এই কথা মাথায় রেখে সুদ আরও কমার আগেই লগ্নি করতে হবে একটু বড় মেয়াদে। সরকারের প্রবীণ নাগরিক সঞ্চয় প্রকল্পে এখনও সুদ দেওয়া হচ্ছে ৮.৫ শতাংশ হারে, যা এইবাজারে সর্বোচ্চ।
ঝুঁকে পড়া ইকুইটির বাজারে কর বাঁচাতে লগ্নি করা যেতে পারে ইএলএসএস প্রকল্পে। অনেকেই বাড়িতে পড়ে থাকা বাতিল নগদ টাকা ব্যাঙ্কে জমা করেছেন অথবা করবেন। টাকা তোলা যেহেতু এখন সহজ নয়, সেই কারণে ওই টাকা লিকুইড ফান্ডে রেখে কম-বেশি ৭ শতাংশ আয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।
যাঁরা বড় মেয়াদে ব্যাঙ্ক এবং গৃহঋণ সংস্থায় টাকা রাখতে চান, তাঁরা সুদ আরও কমার আগেই তা করে ফেলুন।