‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’ এনে টেলি-ময়দানে মুকেশ অম্বানীর ‘ডেটাগিরি’

দেশে কাপড় ব্যবসায় ‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’ এনে ইতিহাস গড়েছিলেন ধীরুভাই অম্বানী। তৈরি করেছিলেন ব্র্যান্ড ‘বিমল’। তার পথে হেঁটে ছেলে মুকেশেরও এ বার লক্ষ্য টেলি পরিষেবার নকশা আমূল বদলে দেওয়া। তাঁর নিজের কথায়, ‘ডেটাগিরি’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

ছেলে আকাশের সঙ্গে মুকেশ। মুম্বইয়ে বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

দেশে কাপড় ব্যবসায় ‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’ এনে ইতিহাস গড়েছিলেন ধীরুভাই অম্বানী। তৈরি করেছিলেন ব্র্যান্ড ‘বিমল’। তার পথে হেঁটে ছেলে মুকেশেরও এ বার লক্ষ্য টেলি পরিষেবার নকশা আমূল বদলে দেওয়া। তাঁর নিজের কথায়, ‘ডেটাগিরি’। বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের বার্ষিক সাধারণ সভার মঞ্চ থেকে সেই লক্ষ্যে পা বাড়ানো শুরু করলেন তিনি।

Advertisement

ঝড় যে আসছে, বেশ কিছু দিন ধরেই তার আঁচ পাচ্ছিল টেলি পরিষেবা শিল্প। কিন্তু এ দিন রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মুকেশ অম্বানী যা বললেন, তা খানিকটা সুনামির মতো। ‘বিধ্বংসী পরিবর্তন’। যা দেখে তার মধ্যে আগমার্কা অম্বানী-ছাপ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। বলছেন, এক সময় পেল্লাই স্বপ্ন, বড় লগ্নি আর নিখুঁত বিপণনের মন্ত্রে এ দেশে পলিয়েস্টার সুতো ও কাপড়ের ব্যবসার চালু ধ্যান-ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই অম্বানী। তৈরি হয়েছিল ব্র্যান্ড ‘বিমল’। লোকের মুখে-মুখে ফিরত তার বিজ্ঞাপনী স্লোগান— ‘ওনলি বিমল’। এখন একই ভাবে ইন্টারনেট মারফত তথ্য (ডেটা) আদানপ্রদানের বিপুল বাজারে দাদাগিরি (ডেটাগিরি) কায়েমকে পাখির চোখ করছে মুকেশের সংস্থা রিলায়্যান্স জিও।

এ দিন মুকেশের বক্তৃতার প্রথম দশ পাতা জুড়ে শুধুই জিও-র পরিকল্পনা! তাঁর দাবি, মোবাইলে কথা বলার জন্য টাকা গোনার দিন শেষ। অন্য সংস্থা যেখানে প্রতি মিনিট কথার জন্য ৬০-৬৫ পয়সা চার্জ নেয়, সেখানে ওই পরিষেবার জন্য আলাদা করে টাকাই নেবেন না তাঁরা। খরচ হবে না এসএমএসেও। নেট পরিষেবার জন্য অন্যদের কাছে ১ জিবি ডেটা কিনতে হরেদরে ২৫০ টাকা খরচ পড়ে। জিও না-কি তা জোগাবে ৫০ টাকায়। বেশি ডেটা ব্যবহার করলে তা নেমে আসতে পারে ২৫ টাকাতেও!

Advertisement

শুধু তা-ই নয়। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংস্থার প্রায় সমস্ত পরিষেবা মিলবে নিখরচায়। স্রেফ পরখ করে দেখতে। সঙ্গে পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ ছাড় কিংবা মোবাইল-অ্যাপের বিপুল সম্ভারের হাতছানি তো আছেই। দু’ই খুব বেশি করে নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে। ঠিক যে ভাবে কাজের দুনিয়ায় নতুন আসা তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে শুরু থেকেই লেপ্টে থাকতে চেয়েছিল বিমল। ২,৯৯৯ টাকায় ফোর-জি স্মার্ট ফোন আনার ঘোষণাতেও কোথাও যেন উঁকি মারছে ধীরুভাইয়ের মুখ। তাঁর মন্ত্রে আস্থা রেখেই যত বেশি সম্ভব ক্রেতার ঘরে পৌঁছতে চাওয়া। মুকেশের লক্ষ্য, গ্রাহকের সংখ্যা দ্রুত ১০ কোটিতে নিয়ে যাওয়া।

টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে পরিষেবা চালুর দিনক্ষণ জানায়নি জিও। পরে মাসুল এক থাকবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু যদি এ দিনের শুরু লম্বা দৌড়ের সঙ্কেত হয়, তবে বদলে যেতে পারে টেলি পরিষেবা বাজারের সমীকরণ। শুরু হবে দরের তীব্র লড়াই।

এ ধরনের আশা-আশঙ্কা আগাম আঁচ করে শেয়ার বাজার ওঠে-নামে। এ দিনও সেই নিয়ম মেনেই হুড়মুড়িয়ে পড়েছে এয়ারটেল, আইডিয়া, টাটা টেলি-সহ প্রায় সমস্ত টেলি সংস্থার শেয়ার দর। এক দিনে বাজার থেকে মুছে গিয়েছে তাদের ১৬,৯৯৭ কোটি টাকার সম্পদ। ৩% পড়ে গিয়েছে মুকেশের তেল শোধন ব্যবসা রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দরও। সম্ভবত এই আশঙ্কায় যে, এখন বেশ কিছু দিন জিও-র স্বপ্নের জ্বালানি জোগাতে হবে তাদের।

টেলি ও নেট পরিষেবার বাজারকে আপাদমস্তক কব্জা করতে মুকেশ যে আটঘাট বেঁধে নামছেন, তার ইঙ্গিত অবশ্য পুরনো। এমনিতেই টেলিকম ব্যবসার প্রতি মুকেশের ‘দুর্বলতা’ বহুল প্রচারিত। অনেকের মতে, অবিভক্ত রিলায়্যান্সের জমানায় টেলিকম সংস্থা রিলায়্যান্স কমিউনিকেশন্স তৈরির মূল কারিগর তিনি। ব্যবসা সাম্রাজ্য ভাগাভাগির সময় তা যায় ভাই অনিলের হাতে। ২০১০ সালে ব্রডব্যান্ডের হাত ধরে এই ব্যবসায় ফেরেন মুকেশ। ঘোষণা করেন ৪,৮০০ কোটি টাকায় ইনফোটেল ব্রডব্যান্ডকে কেনার কথা। ওই সময় ব্রডব্যান্ড স্পেকট্রামের নিলামে একমাত্র সংস্থা হিসেবে দেশের ২২টি সার্কেলেই পরিষেবা দেওয়ার অধিকার পেয়েছিল যারা।

তারপর থেকেই একমনে জিও-র জন্য ঘুটি সাজিয়েছেন মুকেশ। ডিসেম্বরে নিজেদের ফোর-জি পরিষেবার উপর থেকে প্রথম পর্দা তোলে সংস্থাটি। ইতিমধ্যেই তা পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করছেন অন্তত ১৫ লক্ষ জন। পরিকাঠামো গড়তে লগ্নি প্রায় ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। মুম্বইয়ের কাছে তৈরি হয়েছে পেল্লাই নতুন অফিস। শুধু সেখানেই কর্মী ১৫ হাজার। ফি সপ্তাহে সেখানে হেলিকপ্টারে উড়ে আসেন মুকেশ। সঙ্গে ছেলে আকাশ। ইউটিউবের ভিডিও দেখায়, এই নতুন অফিসে মুকেশের নিজের আলাদা চেম্বার নেই। দেশের ধনীতম শিল্পপতি কাজ করছেন বাকি কর্মীদের সঙ্গে বসে। সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, এর পুরোটাই আসলে নিখুঁত বিপণনের প্যাকেজ। বরাবর যাতে আস্থা রাখতেন ধীরুভাইও।

এ দিন ১৯ থেকে ৪,৯৯৯ টাকার ১০টি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুকেশ। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের দাবি, তার অনেকগুলিই অন্যান্য সংস্থার চালু প্রকল্পের থেকে খুব আলাদা নয়। একেবারে ‘ফ্রি’ নয় কথা বলা। সস্তা হলেও তার দাম আসলে ধরা আছে জিও-র প্যাকেজের মধ্যে। কিন্তু পুরো বিষয়টি বিপণনের এমন নিখুঁত সুতোয় মুকেশ গেঁথেছেন, যে এ দিন তা আছড়ে পড়েছে সুনামির মতো।

মার্চে মুকেশ বলেছিলেন, ‘‘ডেটাই এখন রিলায়্যান্সের নতুন তেল।’’ ইঙ্গিত স্পষ্ট। রিলায়্যান্স জিও-র প্রথম লক্ষ্য টেলি পরিষেবার বাজার দখল। দামের লড়াইয়ে বাকিদের পিছনে ফেলে দেওয়া। অন্য সংস্থাগুলির সঙ্গে তেতো লড়াই শুরুও হয়েছে তাদের। বেশ কিছু দিন ধরে টেলিকম সংস্থাগুলির সংগঠন সিওএআইয়ের অভিযোগ, পরীক্ষা করার নামে আসলে আইনকে পাশ কাটিয়ে অন্তত ১৫ লক্ষ গ্রাহককে পুরোদস্তুর পরিষেবা দিচ্ছে জিও। আবার মুকেশদের পাল্টা অভিযোগ, পরিষেবা চালু করতে তাদের অন্যায় ভাবে বাধা দিচ্ছে পুরনো টেলি পরিষেবা সংস্থাগুলি। যেমন, মসৃণ ভাবে পরিষেবা দিতে জরুরি ‘পয়েন্ট অব ইন্টার কানেকশন’ (পিওআই) তাদের কাছ থেকে জিও পাচ্ছে না। এ দিন এই অভিযোগ ফের তুলেছেন মুকেশ। আগামী দিনে এই যুদ্ধেও আরও ‘রক্তপাতের’ সম্ভাবনা।

প্রশ্ন অবশ্য থাকছে জিও-কে ঘিরেও। যেমন, এত কম মাসুলে তারা পরিষেবা দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে যেতে পারবে কি? কখন সম্ভব হবে মুনাফার মুখ দেখা? বাজারের বড় অংশ কব্জায় এলেও দর একই থাকবে তো?

জিও মানে বাঁচো। এ কথা এ দিনও বলেছেন মুকেশ। তবে টেলি পরিষেবা শিল্পে আগামী দিনের লড়াই কার বাঁচা আর কার মরার, সে দিকেই এখন চোখ সকলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন