আবারও মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সুদ কমানোর পথে হাঁটলেন না রঘুরাম রাজন। তবে মঙ্গলবার ঋণনীতি পেশ করার দিনে আসর সরগরম ছিল পরবর্তী দফায় তাঁর হাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রাশ থাকা-না-থাকা নিয়ে জল্পনায়।
সুদের হারের থেকেও এ দিন মাথাব্যথা ছিল আরবিআই গভর্নর পদে রাজন ভবিষ্যতে থাকছেন কি না, তা নিয়ে। আর, সেই বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়ে ঋণনীতির পরে নিয়ম মাফিক সাংবাদিক বৈঠকেই মুখ খোলেন খোদ রাজন। একটি লিখিত বিবৃতি হাতে নিয়েই বৈঠকে আসেন। উত্তেজনা জিইয়ে রেখে মন্তব্য করেন, ৩ সেপ্টেম্বরের পরে তাঁর গভর্নর পদে বহাল থাকা নিয়ে যে ভাবে চাপান-উতোর চলছে তাতে দাঁড়ি টেনে তিনি ‘মজাটা নষ্ট করতে চান না।’ রাজনের কথায়, ‘‘সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি যে ভাবে রসালো করে তুলেছে, তা বন্ধ করাটা আমার তরফে অত্যন্ত নিষ্ঠুর হবে।’’ তিনি আর এই দায়িত্বে থাকতে চান না বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একাধিক ‘চিঠি লিখেছেন’ — সংবাদ মাধ্যমের একাংশের এ নিয়ে সরব হওয়া দেখে তিনি ‘হতভম্ব’ বলেও জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নাকি এ নিয়ে একাধিক চিঠি লিখেছি। আমি তো দেখে অবাক।’’ প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহেই কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে, প্রধানমন্ত্রীকে রাজন নাকি চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি আর আরবিআই গভর্নর থাকতে চান না। সেপ্টেম্বরে কাজের মেয়াদ ফুরোলেই ফিরতে চান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে। আর একটি চিঠিতেও রাজন নাকি লিখেছেন, তাঁকে ঘিরে জল্পনার প্রভাব পড়তে পারে শেয়ার বাজারে।
এ দিন সঙ্গে করে আনা লিখিত বিবৃতি থেকে পড়ে রাজন অবশ্য তাঁর গভর্নর থাকা-না-থাকার ব্যাপারে বলেন, ‘‘সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই বিষয়টি স্থির হবে। যখন সিদ্ধান্ত হবে, তখন অবশ্যই জানতে পারবেন। তার আগে এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিবৃতির উল্লেখ করা ছাড়া আর বেশি কিছু বলার নেই।’’ শেষ কথা যে নরেন্দ্র মোদীই বলবেন, সেই ইঙ্গিত দিয়েছে কেন্দ্রও। মোদী অবশ্য তাঁর মতামত এখনও স্পষ্ট করেননি। বরং বলেছেন, রাজনের কাজের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, সে প্রসঙ্গ সেপ্টেম্বরে উঠবে।
আরবিআই গভর্নর হিসেবে ৫৩ বছর বয়সী রাজনের তিন বছরের কাজের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩ সেপ্টেম্বর। তার পর তা আর বাড়ানো হবে কি না, তা নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজনৈতিক স্তরে। যদিও শিল্পমহল চায়, অর্থনীতিতে স্থিতি বজায় রাখতে গভর্নর পদে থাকুন তিনিই। তাঁর হাতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের রাশ না-থাকলে বহু বিদেশি লগ্নিকারী বিনিয়োগ তুলে নেবেন বলেও ইঙ্গিত মিলেছে। কারণ শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন পড়ানোর সুবাদে বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে রাজন বেশ জনপ্রিয়। মূল্যবৃদ্ধিকে গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের হিসাবের খাতায় অনুৎপাদক সম্পদ খোলাখুলি দেখাতে বলার নীতির জন্যও লগ্নিকারীদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। তবে অনেক সময়েই সুদের হার না-কমানোয় রাজনৈতিক মহল তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তার জেরে আর্থিক বৃদ্ধি ঝিমিয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিতর্কের সূত্রপাত গত মাসে। যখন বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী প্রধানমন্ত্রীকে দু’টি চিঠি লিখে রাজনকে গভর্নর পদ থেকে সরানোর দাবি করেন। তাঁর যুক্তি, মূল্যবৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখার নামে সুদ চড়া রেখে অর্থনীতির ক্ষতি করেছেন তিনি। বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য স্পষ্ট করেছেন, এটা সরকারি বা দলীয় মত নয়।
প্রসঙ্গত, চড়া মূল্যবৃদ্ধির সময়ে ২০১৩-র ৪ সেপ্টেম্বর আরবিআইয়ের হাল ধরেন রাজন। নগদের জোগানে রাশ টানতে রেপো রেট (যে-হারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক আরবিআইয়ের কাছ থেকে ঋণ নেয়) ৭.২৫ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নিয়ে যান তিনি। ২০১৪ সাল জুড়েও চড়া সুদ বহাল থাকে। ২০১৫-র জানুয়ারি থেকে শুরু হয় সুদ কমানো। এ পর্যন্ত ১৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে তিনি রেপো রেট নামিয়েছেন ৬.৫০ শতাংশে। এ দিন সুদ অপরিবর্তিত রেখেও তিনি সুযোগ পেলেই তা কমানোর ব্যাপারে কথা দিয়েছেন। বলেছেন, বছরের শেষে ভাল বর্ষার হাত ধরে মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি কমলেই আরও নামবে সুদ। তিনি বলেন, কম সুদের জমানা থেকে সরছে না শীর্ষ ব্যাঙ্ক। তবে শিল্পমহলের ধারণা, সুদ এই দফায় কিছুটা কমলে ছন্দে ফিরত কল-কারখানায় লগ্নি।