তালুকের জমি কোটির বেশি, পাশেই একর পাঁচ লাখে

শিল্পতালুকে জমি আছে। কিন্তু তালুকের ঠিক বাইরের প্রায় গায়ে লাগা জমির সঙ্গেই তার দামের ফারাক আকাশ-জমিন। তাই এই পরিস্থিতিতে তালুক থেকে কোনও সংস্থা বহু গুণ দরে জমি আদৌ কিনবে কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শিল্পমহল। এর হাতেগরম উদাহরণ হিসেবে হলদিয়া শিল্প তালুকের কথা তুলে আনছে তারা। যেখানে তালুকের জমির দর ওই অঞ্চলেরই অন্য জমির সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় ২৫ গুণ!

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:৪৩
Share:

দামি জমি। হলদিয়া শিল্পতালুক। —ফাইল চিত্র।

শিল্পতালুকে জমি আছে। কিন্তু তালুকের ঠিক বাইরের প্রায় গায়ে লাগা জমির সঙ্গেই তার দামের ফারাক আকাশ-জমিন। তাই এই পরিস্থিতিতে তালুক থেকে কোনও সংস্থা বহু গুণ দরে জমি আদৌ কিনবে কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শিল্পমহল। এর হাতেগরম উদাহরণ হিসেবে হলদিয়া শিল্প তালুকের কথা তুলে আনছে তারা। যেখানে তালুকের জমির দর ওই অঞ্চলেরই অন্য জমির সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় ২৫ গুণ!

Advertisement

শিল্পমহলের অভিযোগ, রাজ্য জমি অধিগ্রহণ থেকে দূরে থাকায় মুখ ফিরিয়েছে বড় শিল্প। এ বার তালুকে জমির দাম নিয়েও এমন অসামঞ্জস্য থাকলে, রাজ্যে লগ্নি করা কঠিন হবে ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলির। সেই ছোট ও মাঝারি শিল্প, যার উপরে জোর দেওয়ার কথা প্রায় নিয়ম করে বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। এবং সেই শিল্পতালুক, যেখানে পর্যাপ্ত জমি থাকার কথা সদ্য শেষ হওয়া শিল্প সম্মেলনেও বারবার বলেছেন তাঁরা।

হলদিয়া শিল্পতালুকে প্রায় ৩০৭ একর জমি রয়েছে। যার প্রতি একরের দর ১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকায় বেঁধে দিয়েছে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম। অথচ ওই তালুক যে মৌজার অন্তর্ভুক্ত, সেখানেই একর-পিছু ৫ লক্ষ টাকার সামান্য বেশিতে জমি কিনেছে একটি বেসরকারি সংস্থা। এবং ওই জমি তারা কিনেছে জমি-মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি। রাজ্য সরকারের নির্ধারিত দামে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তা হলে আর তালুকে জমি নিতে একরে ১.২৬ কোটি টাকা কেউ গুনবে কেন? দেখা যাচ্ছে, সেখানে এখনও পর্যন্ত জমি কেনেওনি কোনও সংস্থা। অভিযোগ, তালুকের জমির জন্য বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা চাইছে রাজ্য।

Advertisement

নিগমের দাবি, জল, বিদ্যুৎ, নিকাশি, রাস্তা-সহ যাবতীয় পরিকাঠামো তালুকে তৈরি। সেই কারণেই ওই বাড়তি টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু সেই যুক্তি খারিজ করে শিল্পমহলের পাল্টা প্রশ্ন, পরিকাঠামো থাকায় জমির দর একরে ৫ লক্ষের বদলে ১৫-২০ লক্ষ হতে পারে। কিন্তু তা এক লাফে কোটি টাকা ছাড়ায় কী ভাবে? শোভারামপুর, দেভোগ ও তেতুঁলবেড়ে মৌজার জমি নিয়ে তৈরি হলদিয়া শিল্পতালুক। এক সংস্থার দাবি, শোভারামপুরে পাঁচ একর জমি ২৬ লক্ষ টাকায় কিনেছে তারা। ফলে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রশ্ন, তা হলে সেখানকারই জমি কোটি টাকার উপরে দর হাঁকার যৌক্তিকতা কী?

শুধু তা-ই নয়। জমির দরে এমন অসামঞ্জস্য ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলিকেই বেশি বিপদে ফেলবে বলে মনে করছে শিল্প। বণিকসভার এক কর্তার মতে, “৩০০ একরের একটু বেশি জমিতে বড় শিল্প হওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ওই তালুকে ছোট ও মাঝারি শিল্পের লগ্নিই আসার কথা। কিন্তু তাদের পক্ষে এত চড়া দরে জমি কেনা মুশকিল। সেই কথা মাথায় রেখে দাম ঠিক করা উচিত।”

জমির দর নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে খাস সরকারি মহলেও। শিল্প দফতর সূত্রে খবর, প্রথমে ওই তালুকে দাম ধরা হয়েছিল একরে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা। কিন্তু নিগমের পরিচালন পষর্দের বৈঠকে তা এক লাফে বাড়িয়ে করা হয় ১.২৬ কোটি।

জমির দর এমন বিভ্রান্তিকর হওয়ায় লগ্নি টানতে রাজ্যের শিল্পতালুকগুলির ব্যর্থতা অবশ্য স্পষ্ট নিগমের ওয়েবসাইটেই। সব মিলিয়ে ১৪টি তালুকে পড়ে আছে প্রায় ৩০০০ একর জমি। তার মধ্যে পরিকাঠামো তৈরি থাকা পানাগড় ও খড়্গপুরের বিদ্যাসাগর তালুকে রয়েছে যথাক্রমে ৫৯৯ ও ৫২৫ একর। উল্লেখ্য, ওই দুই তালুকেও জমির দর একরে ৬০ লক্ষের কাছাকাছি।

ফলে শিল্পমহলের প্রশ্ন, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সামনে যে সমস্ত তালুকের কথা মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেন, সেখানকার জমির দরের খোঁজ তিনি রাখেন কি?

শিল্পমহলের অভিযোগ, শিল্পায়নে আগ্রহী অন্যান্য রাজ্য শুধু জমির সংস্থানই করে না, কোথায় কতটা জমি রয়েছে, তার স্পষ্ট হিসেব গোড়াতেই শিল্পপতিদের সামনে তুলে ধরে। শিল্পতালুক নিয়ে গুজরাত অনেক আগেই ময়দানে নেমেছে। তৈরি করে ফেলেছে সানন্দ-সহ ১৮৫টি তালুক। এমনকী এই কাজে গাঁটছড়া বেঁধেছে চিন, জাপানের সঙ্গে। চলতি মাসের শিল্প সম্মেলনের আগে জমির সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান তৈরি করে ফেলেছে কর্নাটক। যেখানে জেলাভিত্তিক জমির খুঁটিনাটি তালিকাবদ্ধ। জমি-ব্যাঙ্ক তৈরি করেছে তুলনায় পিছিয়ে থাকা মধ্যপ্রদেশও।

অথচ সেখানে জমি নিয়ে সব দিক থেকেই কার্যত শিল্পবিরোধী নীতি আঁকড়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। শিল্পের জন্য সরকার জমি নেবে না। বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে সায় নেই। মান্ধাতা আমলের জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বহাল তবিয়তে বলবৎ। এই পরিস্থিতিতে তালুকের জমির দরেও যদি এমন যৌক্তিকতা না-থাকে, তবে ছোট-মাঝারি শিল্পও আর ঘুরে তাকাবে না বলে আশঙ্কা অনেকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন