কলকাতায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শুনছেন সিআইআই কর্তারা। বাঁ দিক থেকে সন্দীপন চক্রবর্তী, সঞ্জয় বুধিয়া, জে পি চৌধুরী, রাজীব কল এবং সুগত মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম বাজেট শেয়ার বাজারকে তাৎক্ষণিক ভাবে খুশি করতে পারেনি। অন্তত বাজেটের প্রথম দিনে বাজারের প্রতিক্রিয়া থেকে এই চিত্রই উঠে এসেছে। সেনসেক্স পড়ে গিয়েছে ৭২.০৬ পয়েন্ট। বাজার বন্ধের সময়ে সূচক এসে দাঁড়িয়েছে ২৫,৩৭২.৭৫ অঙ্কে। তার জেরে ডলারে টাকার দামও বৃহস্পতিবার পড়েছে ৪৪ পয়সা, যা এক মাসে সর্বোচ্চ পতন। ফলে দিনের শেষে প্রতি ডলারের দাম দাঁড়ায় ৬০.১৯ টাকা।
তবে এটা বাজেট নিয়ে হাজারের চটজলদি প্রতিক্রিয়া বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে বাজেট প্রস্তাবগুলি আর্থিক বৃদ্ধির সহায়ক। তাই অনেক বিশেষজ্ঞেরই ধারণা, আজ শুক্রবার সূচকের মুখ উপরের দিকে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
প্রস্তাবগুলি বিচার করে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সকলেই একমত, জেটলি যে-বাজেট উপহার দিয়েছেন, তা এক দিকে আর্থিক বৃদ্ধিকে স্থিতিশীল করবে, অন্য দিকে শেয়ার বাজারে লগ্নি বাড়াতেও সহায়ক হবে। বাজারের লেনদেন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতেও উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। এ বার দেখা যাক, শেয়ার বাজারকে প্রভাবতি করতে পারে বাজেটে এমন কী কী ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে
• বাজারে লগ্নিতে বিদেশি আর্থিক সংস্থাকে উৎসাহ দিতে তাদের কর ব্যবস্থা সরল করা। বিনিয়োগ থেকে মুনাফা মূলধনী লাভ হিসেবে গণ্য হবে। কর বসবে ১৫%।
• এ বার থেকে একই কেওয়াইসি দিয়ে সমস্ত আর্থিক লেনদেন সারা যাবে। একই ভাবে শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা সব ক্ষেত্রেই একই ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে।
• বন্ডের বাজার চাঙ্গা করতে একাধিক ব্যবস্থা।
• ভারতে বিদেশি সংস্থাকে এত দিন শেয়ার ছাড়তে হত ইন্ডিয়ান ডিপজিটরি রিসিট (আইডিআর)-এর মাধ্যমে। প্রকল্পটিকে আরও সরল করে নতুন নাম ভারত ডিপজিটরি রিসিট (বিডিআর)।
• ভারতীয় সংস্থাগুলি আমেরিকার বাজারে আমেরিকান ডিপজিটরি রিসিট (এডিআর) ও ইউরোপে গ্লোবাল ডিপজিটরি রিসিট (জিডিআর)-এর মাধ্যমেই শেয়ার ছাড়ে। এই প্রক্রিয়া আরও সরল হয়েছে, যার ফলে বেশি সংখ্যক সংস্থা বিদেশের বাজারে শেয়ার ছাড়তে পারবে।
• হিসাব রক্ষার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে সংস্থাগুলিকে। ২০১৪-’১৫ সালে চাইলে ওই বিধি মানা যাবে। ২০১৫-’১৬ থেকে তা হবে ব্যধ্যতামূলক।
• উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহ দিতে যন্ত্রপাতির জন্য বিনিয়োগের উপর করছাড়ের ব্যবস্থা ঢেলে সাজা হয়েছে। এখন থেকে ২৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনলেই তার উপর করছাড় মিলবে। আগে এই সুবিধা পেতে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হত।
• দেশের আর্থিক এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ কিছু ব্যবস্থার কথা বলেছেন জেটলি। যেমন সড়ক উন্নয়নের জন্য ৩৭,৮৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ওই টাকায় জাতীয় সড়ক ছাড়াও রাজ্যের আওতায় থাকা রাস্তাঘাট উন্নয়নের ব্যবস্থাও করা হবে।
• ব্যাঙ্কগুলিকে পরিকাঠামো প্রকল্পে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দিতে বলা হয়েছে। এর জন্য বাজার থেকে আমানত সংগ্রহের বিধি শিথিল করা হয়েছে। পরিকাঠামোয় অর্থের সংস্থান বাড়াতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ট্রাস্ট এবং রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টে বিনিয়োগে করছাড়ের ব্যবস্থাকে আরও আকর্ষণীয় করা হয়েছে।
• প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেছেন জেটলি। বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। এ বার থেকে কোনও বিমা সংস্থার ৪৯% পর্যন্ত শেয়ারের মালিক হতে পারবে বিদেশি সংস্থা। বর্তমানে তা ২৬%। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষায়ও।
• ব্যাঙ্ক শিল্পে অনুৎপাদক সম্পদের বহর কমাতে ছয়টি নতুন ডেট রিকভারি ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার জন্য ছোট ছোট ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে বাজেটে। এর ফলে এক দিকে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনই শিল্প ক্ষেত্রে ঋণের জোগানও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই সব পদক্ষেপ শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করতে বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রবীণ বাজার বিশেষজ্ঞ অজিত দে এবং স্টুয়ার্ট সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান কমল পারেখ বলেন, “এই সব পদক্ষেপ বাজারে কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা এখনই লগ্নিকারীরা অনুধাবন করতে পারেননি। সেটা করলে বাজার যে-চাঙ্গা হয়ে উঠবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।” অজিতবাবুর মতে, “বাজেটে হাতে গরম সুবিধার কথা না-থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আর্থিক উন্নয়নে রসদের ব্যবস্থা করেছেন অর্থমন্ত্রী।”
ব্যক্তিগত আয়কের ক্ষেত্রে যে-করছাড়ের ব্যবস্থা জেটলি করেছেন, তাতে সাধারণ মানুষের হাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের জোগান বাড়বে। যার একটা অংশ শেয়ার বাজারে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ এবং ফিনশোর ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেসের চেয়ারম্যান লক্ষ্মণ শ্রীনিবাসন। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বাড়লে ভারতে ডলারের জোগান বেড়ে টাকার দাম বাড়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করেন তিনি। বাজেট প্রস্তাবগুলি বিশেষ করে বিদেশি সংস্থাগুলিকে ভারতে লগ্নিতে উৎসাহিত করবে। কমলবাবু বলেন, “সূচক পড়লেও বাজেটের দিনই ভারতের বাজারে বিদেশি সংস্থাগুলি ১৬১.৫৫ কোটি টাকা লগ্নি করছে।”