বাড়ি কিনতে ধার জোটেনি, ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র ছিনিয়ে রূপকথা বাঙালির

লড়াই কঠিন ছিল। কিন্তু জেতা ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। কারণ, অন্য যে পথটা সামনে খোলা ছিল, সেটা আত্মহত্যা! অম্বানী-বিড়লা-বজাজদের টপকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘর থেকে ব্যাঙ্ক খোলার ছাড়পত্র (লাইসেন্স) ছিনিয়ে আনার পরের দিন একেবারে ঠান্ডা, নিস্পৃহ গলায় বলছিলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল!

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

ভাইপোর আদর। সল্টলেকের অফিসে বন্ধনের কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ। বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

লড়াই কঠিন ছিল। কিন্তু জেতা ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। কারণ, অন্য যে পথটা সামনে খোলা ছিল, সেটা আত্মহত্যা!

Advertisement

অম্বানী-বিড়লা-বজাজদের টপকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘর থেকে ব্যাঙ্ক খোলার ছাড়পত্র (লাইসেন্স) ছিনিয়ে আনার পরের দিন একেবারে ঠান্ডা, নিস্পৃহ গলায় বলছিলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল!

চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, নিয়ম মেনে সব ঠিকঠাক এগোলে, বছর দেড়েকের মধ্যেই ব্যাঙ্ক হতে চলেছে ‘বন্ধন’। চন্দ্রশেখরবাবুর হাতে গড়া ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রোফিনান্স) সংস্থা। ওই ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তমও বটে। শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঘোষণা অনুযায়ী, ২৫টি সংস্থার মধ্যে কড়া প্রতিযোগিতায় লাইসেন্স জুটেছে মাত্র দু’টির কপালে। তারই একটি ‘বন্ধন’। যার সদর দফতরও হতে চলেছে কলকাতায়।

Advertisement

স্বাধীনতার পর এই প্রথম কোনও ব্যাঙ্ক তৈরি হচ্ছে পূর্ব ভারত থেকে। তা-ও আবার আক্ষরিক অর্থেই শূন্য থেকে শুরু করা এক বঙ্গসন্তানের হাত ধরে। এমন এক সময়ে, যখন অর্থ লগ্নি সংস্থার একের পর কেলেঙ্কারির খবরে কাগজ-টিভি ছয়লাপ। যখন শিল্পপতি তো কোন ছার, লোকসভা নির্বাচনে ভোটপ্রার্থীদের এক বড় অংশও কোটিপতি। এই আবহে সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা শুরু করা এক বাঙালি বছর তেরোর মধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক খোলার পথে পা বাড়াচ্ছেন, এমন ঘটনা তো রূপকথাকেও হার মানায়। ব্যাঙ্কিং শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ তাই বলছেন, “পাঁকে পদ্ম ফোটে। আর চার দিকে পন্জি স্কিমের এঁদো পুকুরে জন্ম নিল বন্ধন।”

বুধবার থেকে চন্দ্রশেখরবাবুর ফোন বেজেই চলেছে। অভিনন্দন-বার্তায় উপচে পড়ছে ইনবক্স। ফুলের তোড়ায় ঢেকে গিয়েছে অফিসের টেবিল। চন্দ্রশেখরবাবু বলছেন, “এই ভিড়ে এমন অনেক তোড়া আছে, যা পাওয়ার আনন্দ একটু আলাদা। কারণ, সেগুলি পাঠিয়েছে এমন কোনও ব্যাঙ্ক বা সংস্থা, যারা এর আগে বহু বার খালি হাতে ফিরিয়েছে আমাকে।”

২০০০ সালে যখন অসরকারি সংস্থার পাঁচ হাজার টাকার মাস-মাইনে ছেড়ে ব্যবসায় নামেন, কোনও ব্যাঙ্ক ধার দেয়নি। বাধ্য হয়ে ২০০১ সালে পৌনে দু’লক্ষ টাকা ধার মহাজনের কাছে। মাসে সাড়ে ৭ শতাংশের চড়া সুদে। ২০০৫ সালে সংস্থার হিসাবপত্র পরীক্ষার জন্য কড়া নেড়েছিলেন এক নামী অডিট সংস্থার দরজায়। তারা রাজি হয়নি। এমনকী ২০০৫ নাগাদ যখন বাড়ি কেনার জন্য ধার চেয়েছিলেন, তখনও প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিল একটি ব্যাঙ্ক। “একটা সময় গিয়েছে, যখন ব্যর্থ হলে আত্মহত্যা ছাড়া পথ ছিল না। কিন্তু আশা ছাড়িনি। ২০০৯ নাগাদ ওই অডিট সংস্থাকেই নিয়োগ করেছিলাম হিসাব দেখার কাজে। আজ বন্ধনকে ঋণ দেয় ৩৪টি ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থা।” —বলছেন চন্দ্রশেখরবাবু।

এমনটা নয় যে চন্দ্রশেখরবাবুই প্রথম বাঙালি, যিনি একটা ব্যাঙ্কের গোড়াপত্তন করছেন। বস্তুত, এ দেশে আধুনিক ব্যাঙ্ক স্থাপনের পথিকৃৎই তো বাঙালি। সেই কবে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যাঙ্ক তৈরি করেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। প্রথম সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরির পথও দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর পর যদুনাথ রায়ের ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্ক। কুমিল্লার দত্তদের ব্যাঙ্ক। কিন্তু এঁরা সকলেই এসেছিলেন রীতিমতো অর্থবান অভিজাত পরিবার থেকে। চাকরি ছেড়েও সংসারের হেঁশেল ঠেলে ব্যাঙ্ক গড়ার চ্যালেঞ্জ এঁদের নিতে হয়নি।

সেখানে ত্রিপুরার আগরতলার কাছে বিশালগড়ে জন্মানো চন্দ্রশেখরবাবু ১১টায় স্কুল পৌঁছেছেন পারিবারিক মিষ্টির দোকানে রোজ সকালে রুটি বেলার পর। আশির দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করতে না করতেই বাবাকে হারিয়েছেন। আর সংসারের হাল ধরতে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়েছেন অসরকারি সংস্থার সামান্য বেতনের চাকরিতে। দেড় দশকে চাকরি পাল্টেছেন না হোক বিশ বার। শেষ পর্যন্ত ২০০০ সালে সব ছেড়ে ছুড়ে মাইক্রোফিনান্সের ব্যবসায়।

“যখন চাকরি ছাড়লাম, স্ত্রী কেঁদে আকুল। সংসার চলবে কী করে?” বলছিলেন চন্দ্রশেখর। ২০০১ সালে মাত্র দু’জন কর্মীকে নিয়ে যাত্রা শুরু। এ রাজ্যেরই কোন্নগর আর বাগনানে। আর আজ দেশের ২২টি রাজ্যে রয়েছে ‘বন্ধন’-এর দু’হাজারের বেশি অফিস। যদিও বাগনান অফিসের সেই চার ফুট বাই ছ’ফুটের কাঠের টেবিলটা রয়ে গিয়েছে আজও।

বৃহস্পতিবার সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে ‘বন্ধন’-এর অফিসে।

ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসেবে কী ভাবে কাজ করে ‘বন্ধন’?

সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ, যাঁদের ঋণ দিতে নারাজ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি, ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি তাঁদের ত্রাতা। ব্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ‘বন্ধন’ তা তুলে দেয় ছোট চাষি বা দোকানদারদের হাতে। এই মুহূর্তে ‘বন্ধন’-এর কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৫৭০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছেন ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। শুধু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই তাদের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৯৬৩ কোটি টাকা।

কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মের জেরে এত দিন বাজার থেকে কোনও টাকা তুলতে পারত না ‘বন্ধন’। টাকার জন্য নির্ভর করতে হতো ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য লগ্নি সংস্থার উপরেই। এ বার নিজেরাই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে পরিণত হলে সেই বাধা কাটবে। আরও সুলভে ধার দেওয়া যাবে নিম্নবিত্ত মানুষদের। চন্দ্রশেখবাবুর কথায়, “এখন ব্যাঙ্ক গ্রাহকের কাছে ৬% সুদে টাকা সংগ্রহ করে। আর সেই টাকা আমাদের ধার দেয় ১৩-১৪ শতাংশে। কিন্তু আমরাই ব্যাঙ্ক হলে, সরাসরি টাকা সংগ্রহ করতে পারব। ফলে আমানত জোগাড়ের খরচ কমবে।”

এটা যেমন সম্ভাবনা, ঠিক তেমনি চ্যালেঞ্জও বটে। ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, সম্প্রতি বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারির জেরে অবিশ্বাস আর অনাস্থার যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তাতে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি সম্পর্কেও অনেকের নজর বাঁকা। তাতে যতই তাদের প্রতি আইনি সমর্থন থাকুক না কেন। ফলে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করে তাঁদের আমানত টেনে আনাটা ‘বন্ধন’-এর প্রথম চ্যালেঞ্জ।

তা ছাড়া, শুধু আমানত সংগ্রহ করতে পারলেই তো হবে না। সেটা করতে হবে লাভজনক ভাবে। যে কাজটা অনেকটা দড়ির উপরে হাঁটার মতো। সেটা দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ চন্দ্রশেখরবাবুদের সামনে। স্টেট ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রতীপ চৌধুরীর কথায়, “ব্যাঙ্ক হলে বন্ধন নিজেরাই আমানত সংগ্রহ করবে। কিন্তু তা সংগ্রহের খরচ লাভজনক ভাবে ঠিক রাখা একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ।”

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি-মাইক্রো ফিনান্স ইনস্টিটিউশনগুলির সংগঠন এমএফআইএন-এর সিইও অলোক প্রসাদের মতেও, একটি ব্যাঙ্কের বছরে কর্মী-পিছু গড় খরচ ৭-৮ লক্ষ টাকা। তাই গ্রাহক-প্রতি ফি বছর গড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকার সঞ্চয় না হলে, কোনও শাখা লাভজনক হয় না। সেই কারণেই গ্রামে সহজে শাখা খোলে না ব্যাঙ্ক।”

চন্দ্রশেখরবাবুর অবশ্য দাবি, “গত চার বছর যখন অর্থ লগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারি নিয়ে অবিশ্বাসের বাতাবরণ চরমে, তখনই কিন্তু দ্রুত বেড়েছি আমরা। ব্যবসার অঙ্ক বেড়েছে। বেড়েছে কর্মী সংখ্যাও। আর এর মূল কারণই হল, বন্ধনের প্রতি গ্রাহক ও কর্মীদের অটুট আস্থা।” ব্যাঙ্কে পরিণত হলেও মূলত নিম্নবিত্ত মানুষদের সেই আস্থারই মর্যাদা দিতে চান চন্দ্রশেখরবাবু। তিনি বলেন, “আমাদের ব্যাঙ্কে কিন্তু ঋণ পাওয়ায় অগ্রাধিকার গরিবগুর্বো মানুষের। তাঁদের দিয়ে কিছু থাকলে, তবেই কর্পোরেট স্বাগত!” ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি ভাস্কর সেনেরও আশা, “বন্ধন ব্যাঙ্ক খুললে, আর্থিক ভাবে সমাজের নীচের তলার মানুষের উন্নয়নে (ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন) আরও বেশি করে সামিল হতে পারবে।”

আর প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের প্রতিক্রিয়া, “এমনিতে আমি বেসরকারি ব্যাঙ্ক গঠনের বিপক্ষে। কিন্তু এটাও বলব যে, দেশে ক্ষুদ্রঋণের যে কর্মকাণ্ড চলছে, সেখানে সর্বাগ্রে রয়েছে ‘বন্ধন’ই। চন্দ্রশেখরবাবু বহু বার আমার কাছে পরামর্শও নিয়েছেন।”

চন্দ্রশেখরবাবু অবশ্য এখন বুঁদ গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়ায়। বন্ধনের ব্যাঙ্ক হওয়ার খবরে গত কাল ফের এক দফা দোল খেলেছেন যাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন