পুস্তক পরিচয় ২

এক পুরুষ-বেশ্যা ও কলকাতার তলপেট

বাংলাদেশের ‘জেনিভা’ ক্যাম্পে আর ভারতবর্ষে দু’বার জন্মানো (দ্বিতীয় বারের জাল জন্মদিন ২৫শে অক্টোবর, অর্থাৎ বলশেভিক বিপ্লবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দিন!) পুরুষ-বেশ্যা জামশেদ আলম আর কলকাতার তলপেট নিয়ে কুণাল বসুর নতুন উপন্যাস। যেন শক্ত হাতে আমাদের মধ্যবিত্ত মুখোশ উপড়ে নিচ্ছেন তিনি।

Advertisement

চিন্ময় গুহ

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০১:৪৯
Share:

বাংলাদেশের ‘জেনিভা’ ক্যাম্পে আর ভারতবর্ষে দু’বার জন্মানো (দ্বিতীয় বারের জাল জন্মদিন ২৫শে অক্টোবর, অর্থাৎ বলশেভিক বিপ্লবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দিন!) পুরুষ-বেশ্যা জামশেদ আলম আর কলকাতার তলপেট নিয়ে কুণাল বসুর নতুন উপন্যাস। যেন শক্ত হাতে আমাদের মধ্যবিত্ত মুখোশ উপড়ে নিচ্ছেন তিনি। একটা বিস্ফোরক বারুদবাক্সের ডালা কান্নার শব্দের মতো খুলে যাচ্ছে।

Advertisement

ভারতীয় ইংরেজি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে কুণাল বসুর প্রধান শক্তি আপন শিকড়কে সম্যক ভাবে জানা। যা শুধু বই পড়ে হয় না। তিনি সক্রিয় ছাত্র-আন্দোলন করেছেন, দায়বদ্ধ কমিউনিস্ট পরিবারের সন্তান, পিতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরকালের গল্পসংগ্রহ-র প্রকাশক, নিজে বাংলা কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ফলে তাঁর ইংরেজি রচনাতেও বিশ্বায়নের সুখী, মেকি প্রসাধন নেই, নেই কৃত্রিম সমাজতত্ত্ব, আছে এক প্রবল আত্মানুসন্ধান।

পিকাডোর ইন্ডিয়া, ৫৯৯.০০।

Advertisement

মধ্যবিত্ত বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে যে কলকাতার রূপকল্প নির্মাণ করেছে, তা অসম্পূর্ণ জেনেও আমরা না জানার ভান করেছি। হুতোম, বটতলা বা পঞ্চানন ঘোষালের রচনা যে ক্ষত উদ্ঘাটন করতে চেয়েছে, অথবা মণীশ ঘটকের পটলডাঙার পাঁচালী, কিংবা নবারুণ ভট্টাচার্যের বিস্ফোরক কথকতা, তা এক বিশেষ জনগোষ্ঠীকে অতিক্রম করেনি। কিন্তু কালকাত্তা? দমিনিক লাপিয়েরের বহু-নিন্দিত (কারণ তা বস্তিজীবনের এমন এক বাস্তব ভাষ্য উপস্থাপন করেছিল যা আমাদের পছন্দ হয়নি) সিটি অব জয়-এ বিহার থেকে আসা হাজারি পালের যেটিকে মনে হয়েছিল ‘দ্য গ্রেটেস্ট আর্বান ডিজাস্টার ইন দি ওয়ার্ল্ড’? যে শহরে বস্তি এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে ধারণ করে আছে, যেখানে দশ লক্ষের কাছাকাছি মুসলমান— যাঁদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, চল্লিশ হাজার খ্রিস্টান, একুশ হাজার জৈন, চোদ্দো হাজার শিখ, পাঁচ হাজার বৌদ্ধ? বিরাট সংখ্যক বিহারি ও মাড়োয়ারি, ওড়িয়া, গুজরাতি, নেপালি, তামিল, মালয়ালি, পঞ্জাবি, কোঙ্কনি, চিনা ছাড়াও কিছু তিব্বতি ও আর্মেনীয়কে নিয়ে যে কলকাতা? আমরা চিনি না। নন্দনগন্ধনন্দিত সাহিত্য-উৎসব নিয়ে আমরা এক মূর্খের স্বর্গে বাস করছি।

কুণাল বসু প্রায় হিংস্র ভাবে এক বিহারি মুসলমান পরিবারের ক্রমশ পুরুষ-বেশ্যায় পরিণত হওয়া জামশেদের জীবনকে ক্লাসিকাল আখ্যান-পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন। তিনি প্রথমেই একটা প্রয়োজনীয় কাজ করেছেন: সেটা হল এই শহরকে ঘিরে তাঁর মধ্যবিত্ত নস্টালজিয়াকে পরিহার করা। কারণ তা তাঁকে প্রকৃত কর্কশ সত্য অনুধাবন করতে দিত না। তাঁর লিখনশৈলীতে তিনি কোনও শৌখিন ‘বিশ্বায়িত’ কাঠামো চাপিয়ে দিয়ে (যা সমকালীন ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের কু-বৈশিষ্ট্য) বাজিমাত করার সহজ পথ নেননি। জামি-র জুতো পরে আমরা এক ভয়ংকর উপ-মহাদেশে প্রবেশ করি। সে একই সঙ্গে এই বইয়ের ভেতরের ও বাইরের কণ্ঠস্বর। যখন তার শিক্ষিতা ‘কাস্টমার’ নারী তার বুকে নির্দয় ভাবে বারবার সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়, অথবা তার সহকর্মিণীর মাথা কমোডে চেপে ধরে কোনও খদ্দের, পাঠকের শিরা ফেটে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে। যখন সে দুর্ঘটনায় নিহত হয় তখন নিজেকে তার মনে হয় ‘আ স্লিপিং এঞ্জেল স্মল এনাফ ফর মিরি টু ক্রেডল ইন হার আর্মস’। পাঠক তাকে খোঁড়া বোন মিরির মতো কোলে করে দোলায়। শৈলী হয়ে যায় অদৃশ্য। কঠিন ও সটান গদ্যের ভেতর থেকে ক্রমশ উত্থিত হয় এক অন্য রকম গীতিধর্মিতা। যা মনে করায় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য মিনিয়েচারিস্ট-এর কথা ।

১৪ নং জাকারিয়া স্ট্রিটে দরিদ্র বিহারি মুসলমান জীবন হয়ে ওঠে গোটা বিশ্বের যন্ত্রণাক্ত আর্তনাদ। একটি রাস্তা, একটি এলাকা হয়ে ওঠে এই গ্রহের জীবনরেখা। প্রবল প্রহার, কর্দমাক্ত রক্তের তিক্ত স্বাদ দিয়ে যার সূচনা হয়। অতঃপর মূল আখ্যান শুরু হয়েছে বালকের সুন্নত দিয়ে। বাংলাদেশি বিহারি মুসলমান শরণার্থী কেন্দ্রে এপারের কমিউনিস্ট কাকার সাহায্যে জামশেদ ও তার পরিবারের ইন্ডিয়া আসার প্রস্তুতি ছোট ছোট তুলিটানে ফুটিয়ে তোলা। পরে জাকারিয়া স্ট্রিটে মুস্তাক কাকার বাড়িতে। মরা গরুর গন্ধ, পায়রার বিষ্ঠা, মিনিবাসে উঠে ছুট, আব্বুর দরজির দোকান, আম্মুর জরির কারখানায় কাজ। বন্ধুরা— রাকিব, মুন্না, বাক্কি... ছাদ থেকে স্নানরতা নারী দেখার আনন্দ, জলের ট্যাঙ্কের পেছনে আত্মীয়াকে চুম্বন, ‘গন্দা’ বই, ‘গসিপ-কি-রানি’ সামিনা। আজান ডুবিয়ে দেওয়া হনুমান মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, সর্বোপরি এক আশ্চর্য মেয়ে বোন মিরির অপরূপ পাকা পাকা কথা। মাড়োয়ারি ভূতের গল্প বলার সময় আখ্যানভাগ হঠাৎ ডানা মেলে ওড়ে। ইস্কুল থেকে বিতাড়িত নায়ক এক পাসপোর্ট জাল করার অফিসে চাকরি পায়। তারপর কলকাতার ওপরতলার এক মোহিনী মণিকা গোস্বামী শরীরের অমোঘ জাদু-আকর্ষণে তাকে টেনে নেয় কালকাত্তার গভীর তলদেশে। সে জামিকে মাসাজ-পার্লারে টেনে আনে। এ এক অন্য কলকাতা। স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের মাঝে ধোঁয়াশাভরা এক ধূসর স্পেসে জামির ‘যৌথ’ জীবন শুরু হয়। ধনী, সম্ভ্রান্ত, অতৃপ্ত, ক্রীড়াপ্রেমী নারীরা, সেই সব সুন্দরী কালকাত্তায় যাদের আড়ালনাম ‘থিসসা’, সুজানের মতো বিদেশিনীরা... বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে। জামি দেখে তার ‘ব্ল্যাক ফরেস্ট’ কেক ভাল লাগছে শাহি কোর্মার চেয়ে!

বইটির ভেতরে ভেতরে নিরন্তর চলে বাঙালি কলকাতার সঙ্গে লড়াই। বইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠাগুলি প্রথমার্ধের শেষাংশে, যেখানে একটি খসে পরা বোতামের খোঁজে জামি জোব চার্নকের সমাধিলেখের সামনে গিয়ে পড়ে। এক পাথর-কঠিন গদ্যে হঠাৎ লাগে মায়াবাস্তবের ছোঁয়া ।

দ্বিতীয়ার্ধে (যার নাম ‘অদৃশ্য আগুন’) এই ‘ইল্‌লিগাল এলিয়েন’-এর কাহিনি ক্রমশ অস্তিত্ববাদী হয়ে ওঠে। তখন চাকরি ছেড়ে জামি পুরোদস্তুর মাসাজ-ওয়ালা হয়ে গেছে। যখন সে ভদ্রসমাজের কাছে ‘কামিনা’, যার পোশাকে নারীগন্ধ। তার সামনে যেন সারি সারি ইমপ্রেশনিস্ট ছবি। এক দিকে মেকি শিল্প-আলোচনা, অন্য দিকে ঝাড়লণ্ঠনের নীচে ঝলমল করা মধ্যপ্রাচ্যের ঘড়ি। প্রস্রাবের গন্ধভরা করিডর এবং সুগন্ধি মোমবাতির দোলাচল। মাসাজ-পার্লারের নাম ‘চম্পক’। এ যেন যন্ত্রণার কবিতা, যা বোদল্যেরের ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর কথা মনে করায়। প্রায় দু’দশক কালকাত্তার তলপেটে বাস করে যেন কখন অজান্তে জামি হয়ে ওঠে সার্ত্র-বর্ণিত ‘সন্ত ও শহিদ’— তস্কর, পুরুষ-বেশ্যা ও নাট্যকার জাঁ জ্যনের মতো। রক্ত থমকে যায়, থাকে শুধু যন্ত্রণা। ‘হাঙরের দাঁত-ওলা ডলফিনেরা কিনে নিচ্ছে কলকাতাকে। ‘মন্দিরা নামে এক বিবাহ-বিচ্ছিন্না শিক্ষিতা বিষণ্ণ নারী ও তার রক্ত-কর্কটে আক্রান্ত সন্তান পাবলো খুলে দেয় বিকল্প এক সুদূর অপ্রাপণীয় আকাশের জানলা।

সাহিত্য তো জীবনের পুনর্নির্মাণ, যদিও সেই জীবন কখনও পুঁজ আর রক্তক্লেদে ভরা। অন্য কলকাতার— হয়তো প্রকৃত কলকাতার— কথা বলতে গিয়ে এক অসহায়তার গাথা শুনিয়েছেন লেখক। কলকাতা হয়ে উঠেছে কতগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা যেখানে শুক্র লেগে আছে। যেন র‌্যাঁবোর নরকে এক ঋতু নতুন করে মেলে ধরছে বেঁচে থাকার এক আজগুবি উপকথা। জামির নৈরাশ্য ও লাজুকতা, বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসঘাতকতা এমন এক বহুমাত্রিক জীবনসত্যের দিকে আমাদের টেনে নেয় যা তাকে সন্ত জামি করে তোলে। দীর্ঘকায় জামি কি আসলে দস্তয়েভস্কির রাসকলনিকভ? উপন্যাসের শেষ পর্ব (যার নাম ‘স্বর্গ’)— যখন সে পাবলো-কে সাহায্য করতে ব্যর্থ, খোঁড়া বোন মিরিকে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে যুক্তিহীন ভাবে বন্দি করা হয়েছে— হয়ে ওঠে এক সুররিয়েল ভাষ্য। মিরিয়াম বলে: ‘আল্লার জন্য কিছু করো জামি... বিয়ে করো। এই পৃথিবীতে একজন সন্তানকে আনার মতো বিশুদ্ধ যে আর কিছু নেই।’

এই আগুন-বৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে ক্লেদ, যন্ত্রণা, অসহায়তা পার হয়ে বোদল্যের সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর অমৃতকথা মনে পড়ে আমাদের: ‘মানুষ দুঃখী, কিন্তু সে জানুক সে দুঃখী; মানুষ পাপী, কিন্তু সে জানুক সে পাপী,...মানুষ মুমূর্ষু এবং সে জানুক সে মুমূর্ষু; মানুষ অমৃতাকাঙ্খী, এবং সে জানুক সে অমৃতাকাঙ্খী।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন