দর্পণে বিম্বিত এ কোন বাঙালি

এমন একটি জটিল সামাজিক অবস্থানের উপর গড়ে ওঠা শহরের ইতিহাস চর্চা শুধুমাত্র সালতারিখের কচকচানি কিংবা দালানকোঠার দেমাকি বর্ণনার উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলতে পারে না।

Advertisement

দেবদত্ত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

আদি পঞ্জিকা দর্পণ
অসিত পাল
৬০০.০০
সিগনেট প্রেস

Advertisement

অবাক শহর, আজব শহর, মৃত শহর, কল্লোলিনী এমন হাজারো নামে ও বিশেষণে কলকাতা পরিচিত। তবে বিশেষণ যাই হোক না কেন বিশ্বের আর দশটা শহরের মতো কলকাতারও একটা নিজস্ব যাপন ছিল এবং আছে। সেই যাপনের সঙ্গে এ দেশের মানুষেরই শুধু নয় পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ ও জাতির শিকড় সন্ধানের গল্পও জড়িয়ে রয়েছে। এই বহুজন সমাগম কলকাতাকে একটা স্বাতন্ত্র্য এবং চরিত্রগত ভিন্নতা দিয়েছে। সেই সব মানুষ কলকাতায় এসে যে কেবল বসত করেছে তাই নয়, কলকাতার মাটিতে বসে তারা চর্চা করেছে নিজেদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির বিবিধ আঙ্গিক। শুধু ইংরেজ কেন, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার, পর্তুগিজ়, আরমানি, গ্রিক, চিনা কে নেই সেই চর্চায়! এদের সঙ্গে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ আর সর্বোপরি বাঙালি তো আছেই।

এমন একটি জটিল সামাজিক অবস্থানের উপর গড়ে ওঠা শহরের ইতিহাস চর্চা শুধুমাত্র সালতারিখের কচকচানি কিংবা দালানকোঠার দেমাকি বর্ণনার উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলতে পারে না। বরঞ্চ এই শহরের ইতিহাস চর্চায় অনেক বেশি নির্ভর করা প্রয়োজন নানা সময়ের দলিলদস্তাবেজ, দিনলিপি, লিপিফলক, ভ্রমণবৃত্তান্ত, জাহাজি দলিল, মহাফেজখানায় রক্ষিত তথ্য, প্রাচীন চিত্র, আলোকচিত্র, মানচিত্র ইত্যাদি উপাদানের উপর। পঞ্জিকা তেমনই এক উপাদান। বিভিন্ন প্রকাশকের নানা চেহারার পঞ্জিকার পাতায় পাতায় ধরা আছে কলকাতার নাগরিক জীবনচর্যার বিবিধ দিকের পাশাপাশি গোটা বিশ্বের সঙ্গে বাঙালির যোগাযোগের নিবিড় কাহিনি। যে কারণে কুইন থেকে শুরু করে মেম সাহেব, ম্যাজিক লণ্ঠন থেকে শুরু করে ওয়াচ ক্লক কী নেই পঞ্জিকায়? এ সব ছবি বা বিজ্ঞাপন এমনই বিশ্লেষণের দাবিদার যাকে কেবল নথির ভিত্তিতে পড়ে গেলেই হয় না, দরকার হয় বহুমুখী দৃষ্টিকোণ।

Advertisement

নানা সময়ে পঞ্জিকার সঙ্গে বাঙালির ওঠাবসার সম্পর্কের চেহারাটি যতই কেবল হাতে পাঁজি মঙ্গলবার গোছের হোক না কেন তা যে নগর ইতিহাস চর্চার অমূল্য দলিল তাতে সন্দেহ নেই। ইদানী‌ং বটতলার ছাপাছাপির ইতিহাস কেন্দ্রিক যে ক’টি গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠকের হাতে ঘোরাফেরা করছে তার মধ্যে আলোচ্য বইটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ শুধু পঞ্জিকাকে নির্ভর করে এত তথ্যের নথিকরণ এর আগে হয়নি। অজানা তথ্য, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, নির্ভরযোগ্য তথ্যের বিপুল উপস্থিতি নিয়ে এই গ্রন্থের বিস্তার। প্রায় ছ’শো পাতা জুড়ে সে কালের জীবনচর্যার হাজারো উপাদান। ঘড়ি, তেল, কলকব্জা, ছবি, ছায়াচিত্র, ম্যাজিক, কবিরাজি, রাবারস্ট্যাম্প, হরফ, শিল্পী, সাবান, পাঁচালি, কেলেঙ্কারি, রাস্তার হিসেব, পুজোআচ্চার নিয়মকানুন, মহরম, সাহেব, প্রহসন, বাইজি, পালাপার্বণ, গুপ্তকথা, বিজ্ঞাপন, মনুসংহিতা, কলকাতার পথ, রাজা-রানি, খবরের কাগজ, সেলাই কল, রেলগাড়ি-সহ পঞ্জিকা কী ভাবে ডিরেক্টরি হয়ে উঠেছে তার নিখুঁত নথি। সঙ্গে সেই সব নথির প্রসঙ্গে নানা তথ্য। ছবি ধরে ধরে বিস্তারিত করা হয়েছে সেই সব আলোচনাকে।

যেমন ‘ধরাখানা যেন বিজ্ঞাপনে ভরা’ এই পর্বে অসিতবাবু ধরে ধরে বিজ্ঞাপনের কপির ভাষাকে ছবির উদাহরণ সহ তুলে ধরেছেন। সেই সময়ের একটি ম্যাজিক লণ্ঠনের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, ‘‘এই লণ্ঠনের আশ্চর্য গুণ দেখিলে বিস্ময়াপন্ন হইবেন। যাহা কেবল গল্পে শুনিয়াছেন তাহা স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন। ব্যবসায়ীগণ এই লণ্ঠনের দ্বারা ছায়াবাজী (ম্যাজিক) দেখাইয়া অনেক পয়সা উপার্জ্জন করিতে পারিবেন এবং সৌখিন যুবকগণ আমোদ-প্রমোদে রাত্রি কাটাইতে পারিবেন প্রত্যেক গ্রাহককে ম্যাজিক দেখাইবার বাঙ্গালা নিয়মাবলী দেওয়া হয়।’’ এই ভাবেই অসিতবাবু সেই সময়ের বহু জিনিসের বিজ্ঞাপন ও তার কপিকে নিখুঁত ভাবে নথিবদ্ধ করেছেন। আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অভীষ্ট ক্রেতার চেহারাটিও। যেমন এখানে অভীষ্ট ক্রেতা ব্যবসায়ী আর ‘আমোদ’ করে রাত কাটানো ‘যুবকগণ’। এই নথি বিজ্ঞাপনের কপির চেহারা বদলের পরম্পরাকেও বুঝতে সাহায্য করে। হদিশ পাওয়া যায় জীবনযাপনের কোন দিকগুলির প্রতি বিজ্ঞাপনদাতা বিশেষ নজর রাখছেন। যেমন ঢালাও গুপ্তকথার বিজ্ঞাপন। কপি নিজেই গল্প বলছে অনেকটা। এমন উদাহরণ অজস্র। ‘কলিকাতা রহস্য কাহিনী’ বইয়ের বিজ্ঞাপন: ‘‘কলিকাতা সহরের অনেক গুপ্ত কাণ্ডের পরিস্ফুট ছবি ইহাতে আছে। আরও আছে অনেক বড় ঘরের বড় কথা,... দেবর হইয়া ভ্রাতৃজায়ার উপর হেয়তম জঘন্য পাশব অত্যাচার, কলঙ্কিনী আমোদিনী ও কুহকিনী মহামায়ার বীভৎস কলঙ্ক-কাহিনী, গুপ্ত প্রণয়ের শোচনীয় পরিনাম। গভীর নিশীথে গঙ্গাবক্ষে ভাসমান বজরা অভিমুখে শকটারোহনে প্রেমোন্মাদিনী আমোদিনীর সুদূর অভিসার যাত্রা।’’ যৌনতানির্ভর ভাষা কী ভাবে বিজ্ঞাপনদাতার অস্ত্র হয়ে উঠছে তার বহু নিদর্শন ধরা আছে এই বইতে। বাঙালির কাম চর্চা বা যৌন যাপন নিয়ে কোনও গবেষণায় একটা শতকের নিরিখে পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন যে দলিল হয়ে ওঠে তা বোঝা যায় এই বইটি পড়লে।

আবার ‘পাঁজি চেনা যায় ছবিতে’ অধ্যায়ে ছবি রচয়িতাদের প্রসঙ্গে চমৎকার অন্বেষণ করেছেন লেখক: ‘‘উনিশ শতকেই ত্রৈলোক্যনাথ দেবের ‘উদ্ভিদবিচার’ (১৮৬৯ খ্রি) বইটিতে ৪৩২টি সরু রেখা নির্ভর কাঠ খোদাই-এর কাজ ছিল। বইতে উল্লেখ ছিল ত্রৈলোক্যনাথের নাম, কিন্তু ওইসব ছবির খসড়া করে দিয়েছিলেন আর্ট স্কুলের সেই সময়ের ছাত্র উদয় চাঁদ সামন্ত।’’ গুরুত্বপূর্ণ খোঁজ সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথা থেকে এই সূত্র মিলল তার উল্লেখ থাকলে অন্য গবেষকদের খোঁজার সুযোগ তৈরি হত। কী ভাবে তলায় তলায় পঞ্জিকার হাত ধরে পাল্টে যাচ্ছে চিত্র চর্চার নানা উপাদান তাও অসিতবাবুর চোখ এড়ায়নি।

অসিতবাবু ‘লক্ষ্মীপূজা প্রসঙ্গ’ আলোচনা করতে গিয়ে ধরে ধরে দেখিয়েছেন দে. ল. এন্ড কোং পঞ্জিকায় ১৮৭৫-৭৬’এ হীরালাল কর্মকারের ছাপা লক্ষ্মীর ছবির ইউরোপীয় ধারাকে কী ভাবে বদলে দিয়েছিলেন অজ্ঞাতনামা এক শিল্পী। ফলে পঞ্জিকায় লক্ষ্মীর ছবিতে যুক্ত হল মুঘল ছাপ। আবার ১৯০৩-এ বেণীমাধব দে-র পঞ্জিকায় লক্ষ্মী কী ভাবে পোশাকে পরিচ্ছদে বাঙালি কনেবউ হয়ে গেলেন তা ধরে ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন অসিতবাবু। ১৯০৫-এ লক্ষ্মীর মাথার উপরে এল উজ্জ্বল আলোর বলয় আর ১৯১৪ থেকে বিপুল পরিমাণে ব্যাকড্রপ ল্যান্ডস্কেপ। এ ভাবেই রয়েছে আরও অনেক দেবদেবীর বিবরণ।

এ সবের আড়াল থেকেই উঠে আসতে চায় আরও কিছু কথা। যেমন কবিরাজি চিকিৎসার অজস্র বিজ্ঞাপন জুড়ে কেবলই সে কালের পুরুষের ইন্দ্রিয় নিতান্ত নিস্তেজ, শিথিল, খর্বাকার ইত্যাদি বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। রতিবিলাস তৈল, বিজয় বটিকা, হাতী মার্কা সালসা, রতিশক্তি বটিকা, রতিবিলাস বটি, প্রমেহশান্তি বটিকা, মহাশক্তি রসায়ন, রতি বিজয় বটিকা, ইন্দ্র বীর্য তৈল, স্বাস্থ্য সুধা, কল্পামৃত সহ হাজারো কবিরাজি ঔষধের সেবনেই যেন বাঙালির এ হেন বিপদ থেকে মুক্তি। বাঙালিকে শারীরিক ভাবে দুর্বল প্রতিপন্ন করার বিপুল ছবি উঠে আসে পঞ্জিকায় কবিরাজি বিজ্ঞাপনের আড়ালে। পঞ্জিকার বইপত্র বা ওষুধের বিজ্ঞাপন যেন দুর্বল বাঙালি, লম্পট বাঙালি, দিনক্ষণ শুভাশুভ মেপে চলা বাঙালি, বেশ্যাপ্রিয় বাঙালি, আর সর্বোপরি ইংরেজের নকলনবিশ বাবু বাঙালির এক বিপুল দর্পণ। এই দিকটি আরও বিস্তারিত ভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ ছিল বইতে। আবার বিজ্ঞাপনের অক্ষরের বিচিত্র চরিত্র নিয়ে আর বিভিন্ন ছাপাই মেশিনের ভূমিকা কী ভাবে পঞ্জিকা ছাপার জগতে কালে কালে বিপুল বদল এনেছে সে প্রসঙ্গেও এখানে আলোচনার সুযোগ ছিল। বহু ক্ষেত্রে ভেতরের ছবি আর একটু স্পষ্ট হলে ভাল হত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন