পুস্তক পরিচয় ১

তাঁকে ফিরে পড়া আজ অত্যন্ত জরুরি

আত্মবিস্মৃত বাঙালি খেয়াল রাখেনি, এই বছরটিই ছিল অনন্তলাল ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। কে অনন্তলাল, এক কথায় উত্তর সম্ভব নয়। ন্যায় এবং বৈশেষিক দর্শনের বিশেষজ্ঞ। শেষ বয়সে ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব বৈশেষিক ফিলজফি’ লিখেছেন।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:৩৩
Share:

আত্মবিস্মৃত বাঙালি খেয়াল রাখেনি, এই বছরটিই ছিল অনন্তলাল ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। কে অনন্তলাল, এক কথায় উত্তর সম্ভব নয়। ন্যায় এবং বৈশেষিক দর্শনের বিশেষজ্ঞ। শেষ বয়সে ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব বৈশেষিক ফিলজফি’ লিখেছেন। তার আগে বাচস্পতি মিশ্রের ‘ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যটীকা’, উদয়নের ‘ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যপরিশুদ্ধি’ অবধি লুপ্তপ্রায় বহু পুথিকে তিনিই সম্পাদনা করে নিয়ে এসেছিলেন পাঠকের কাছে। ন্যায়ের পাশাপাশি বৌদ্ধ শাস্ত্রেও সমান দখল। এই দেশে অতীশ দীপঙ্করের গুরু জ্ঞানশ্রী মিত্রপাদ থেকে বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি, রত্নকীর্তি অনেকের রচনাই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ মঠে কিন্তু সেগুলি মধ্যযুগেই অনূদিত হয়েছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তিব্বত থেকে সেই সব পুথির অনুলিপি এ দেশে নিয়ে আসার পর সেগুলি যিনি মূল সংস্কৃতে ফের তর্জমা করে দেন, তিনিই অনন্তলাল ঠাকুর। মহাভারত নিয়েও প্রবল উৎসাহী, একদা গোপাল হালদারের সম্পাদনায়, নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি থেকে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের যে সংস্করণ বেরিয়েছিল, অনন্তলালই লিখেছিলেন তার ভূমিকা।

Advertisement

ফরিদপুরের কোটালিপাড়া অঞ্চলে উনশিয়া গ্রাম। সেখানেই ১৯১৬ সালে অনন্তলাল ঠাকুরের জন্ম। বাবা গোবিন্দচন্দ্রের টোল ছিল, যজন-যাজন-অধ্যাপনায় দিন কাটাতেন। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারটি তেজস্বিতায় বিখ্যাত। এই পরিবারেই পাঁচ পুরুষ আগে ছিলেন কৃষ্ণজীবন ঠাকুর। গুরুপূর্ণিমার দিন তখন গুরু শিষ্যদের বাড়ি যেতেন, তাঁরাও প্রণামী দিতেন। কৃষ্ণজীবন প্রথমে যেতেন জমিদারের বাড়ি, তার পর অন্যদের কাছে। এক গরিব মুনিষ এক দিন কেঁদে পড়ল, ‘বাবাঠাকুর, আপনি আগে না এলে আমি চাষে বেরোতে পারব না। সে দিনটা বউ-বাচ্চা নিয়ে উপোসে কাটাতে হবে।’ কৃষ্ণজীবন কথা দিলেন, তার বাড়িতেই আগে যাবেন। শিষ্য জমিদার রেগে আগুন, ‘সে কি, আমার সেরেস্তায় ওর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।’ কৃষ্ণজীবন পাল্টা বললেন, ‘আমি তোমার ভৃত্য নাকি? পয়সার এতো গরম! তোমার দেওয়া দেবত্র জমিটি অবিলম্বে ফেরত নাও। আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতেও আমার পরিবারের কেউ তোমার বাড়িতে আসবে না।’

গোবিন্দচন্দ্রের টোলেই অনন্তর হাতেখড়ি। কিন্তু পুত্রকে শুধু সংস্কৃত পাঠে আবদ্ধ রাখতে চাননি বাবা। ইংরেজি শিক্ষার জন্য কোটালিপাড়া ইউনিয়ন স্কুলে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন সংস্কৃত কলেজে। থাকেন দিদি, জামাইবাবুর কাছে। তাঁর জামাইবাবু চিন্তাহরণ চক্রবর্তী প্রাচ্যবিদ্যা ও ভারততত্ত্বে উজ্জ্বল নাম। সংস্কৃত কলেজের পর এম এ ক্লাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলেন অনন্তলাল, পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। বিভাগীয় প্রধান বিধুশেখর শাস্ত্রী তাঁকে সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি তিব্বতি, চিনা ভাষা শেখায় উৎসাহ দেন।

Advertisement

শোনা যায়, সংস্কৃত বিভাগে তখন ছিলেন প্রভাবশালী এক অধ্যাপক… সাতকড়ি মুখোপাধ্যায়। বিধুশেখরের সঙ্গে তাঁর ‘মধুর’ সম্পর্ক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিন্দে অনেকের জানা। সাতকড়িবাবু অনন্তলালকে পরামর্শ দিলেন, ‘তুই ভাল ছেলে। ওকে ছেড়ে আমার কাছে গবেষণা করতে চলে আয়।’ কৃষ্ণজীবনের বংশধর সাফ উত্তর দিলেন, ‘কেন? উনি তো আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি।’ সে বার সংস্কৃতে একটি ফেলোশিপ ছিল, অনন্তলাল ঠাকুরই পেলেন। সাতকড়িবাবু আরও রেগে গেলেন, ‘ঠিক আছে। এখানে কী ভাবে কাজ করে, দেখে নেব।’ অনন্তলাল ঠাকুর যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে আজীবন পটনা, দারভাঙ্গা ও মিথিলায় কাজ করতে বাধ্য হলেন, তার আসল কারণ এখানেই। অনিলায়নের ঢের আগে থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র।

অনন্তলাল গবেষণা করতে গেলেন পালি বিভাগে বেণীমাধব বড়ুয়ার অধীনে। অস্থায়ী চাকরি পেয়েছেন কৃষ্ণনগর কলেজে, মাঝে মাঝে কলকাতায় আসেন। এক বার এসে শুনলেন সুখলাল সঙ্ঘবির বক্তৃতা। তিনি বলছিলেন, তাঁর বন্ধু রাহুল সাংকৃত্যায়ন তিব্বত থেকে প্রায় আড়াইশো পুথির অনুলিপি নিয়ে এসেছেন, সেগুলি পটনা মিউজিয়ামে রাখা আছে।

সে সবের মধ্যে কোথাও কি থেকে যেতে পারেন ন্যায়শাস্ত্রকার উদয়নাচার্য? তাঁর শিক্ষক ফণিভূষণ তর্কবাগীশের কাছে এক দিন উদয়নের ‘ন্যায়বার্তিকতাৎপর্যপরিশুদ্ধি’ পড়তে চেয়েছিলেন অনন্তলাল। তর্কবাগীশ মশাই হেসেছিলেন, ‘সে বই আমি কোনও দিন দেখিনি। বৌদ্ধ মত আর ন্যায় মতের দ্বন্দ্বে অন্যরা কিছু কিছু জায়গা উদ্ধৃত করে গিয়েছেন, সেগুলিই পাওয়া যায়। আসল পুঁথি কেউ দেখেনি।’

বেণীমাধব বড়ুয়া ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন, অনন্তলাল চলে গেলেন পটনায়। চাকরি করেন কাতরাসগড় কলেজে, অন্য সময় রাহুলের আনা পুথির কপি খুঁটিয়ে দেখেন। এই জায়গাটা পোকায় কেটেছে? অন্য কোনও দার্শনিক কী পূর্বপক্ষ হিসাবে এক বারও উদ্ধৃত করেননি এই পংক্তিটিকে?

মেধাবী ও পরিশ্রমী অনন্তলাল ঠাকুরকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মিথিলা ইনস্টিটিউট ও দারভাঙ্গা বিশ্ববিদ্যালয়ই তৈরি করে দিয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি। অবসরের পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি। মারা গিয়েছেন এই সে দিন, ২০০৯ সালে।

এই লেখকের অনেকগুলি বাংলা নিবন্ধ দুই মলাটে গেঁথেই বই। ৪৬২ পৃষ্ঠার বই সুস্পষ্ট কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত নিয়ে ২৩টি, ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন নিয়ে ২০টি, বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে দুটি প্রবন্ধ। এ ছাড়াও শঙ্করাচার্য, প্রভাকর মিশ্র থেকে ফণিভূষণ তর্কবাগীশ প্রমুখের জীবনী। বাঙালি ভুলে গিয়েছে, উনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্তির আগেও তার নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল। নবদ্বীপে রঘুনাথ গোস্বামীদের নব্যন্যায়, শ্রীধর আচার্য, শালিকনাথের মীমাংসা দর্শন তখন সারা ভারতে প্রভাব ফেলে। মায় অদ্বৈত বেদান্তে শঙ্করাচার্যের গুরু গৌড়পাদও বাঙালি। ‘সাংখ্যদর্শন ও যোগদর্শন নিয়ে বাঙালি সম্ভবত খুব একটা নাড়াচাড়া করেনি,’ এই বইয়ের এক নিবন্ধে জানিয়েছেন লেখক।

কেমন তাঁর মানসিকতা? ‘হিন্দুধর্মে সংস্কার ও সমন্বয়’ প্রবন্ধে তাঁর বিশ্বাস বাল গঙ্গাধর তিলকের মতোই। বেদ পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। আর্যরা বহিরাগত নয়। কয়েক জায়গায় বেশ মুসলমানবিরোধী।

কিন্তু ওই সব বক্তব্যে আবদ্ধ থাকলে ‘সেকুলার’ পাঠক-ই বঞ্চিত হবেন নৈয়ায়িকের শাস্ত্রসম্মত দৃষ্টি থেকে। কখনও তিনি পরিষ্কার জানান, ‘ন্যায়শাস্ত্রে কোনও জীবকেই ছোট বা বড় বলা হয়নি। দার্শনিক এক আত্মাকে কখনই অন্য আত্মার চেয়ে ছোট বা বড় বলেন না। ঋষি, আর্য ও ম্লেচ্ছ সমান আপ্তবলে গৃহীত।’ আবার কখনও ১৮৭০ সালে কাশীর এক ধর্মসভায় ভারতীয় পণ্ডিতরাই যে নিজেদের হিন্দু বলতে রাজি হননি, সে কথাও জানিয়ে দেন: হিন্দুশব্দো হি যবনেষ্বধর্মিজন বোধকঃ। মানে, পারসিকরা ডাকাত অর্থে হিন্দু শব্দ ব্যবহার করে। নৈয়ায়িক উদাহরণ দিয়ে জানান, বশিষ্ঠ চণ্ডালকন্যা অক্ষমালাকে বিয়ে করেছিলেন। মৎস্যরাজ বিরাটের স্ত্রী দাসকন্যা। ‘ভিন্ন মত এবং ভিন্ন আচার যদি লোককল্যাণের পরিপন্থী না হয়, তাহার জন্য প্রাচীন ভারতবর্ষ কাহাকেও নিগ্রহ করে নাই।’

অনন্তলাল ঠাকুরের মতো পণ্ডিতকে আজ বারংবার ফিরে পড়তে হয় এই কারণেই। উপনিষদের ‘ব্রহ্মবিহার’ মানে তো সকলের আনন্দে সমান আনন্দের অনুভব। ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ নিবন্ধে লেখকের মন্তব্য, ‘সকল বলিতে কেবল স্ববর্ণ বা স্বদেশবাসী বা মানবমাত্র না বুঝিয়া প্রাণীমাত্রকে বুঝিতে হইবে।’ এক দিকে হিন্দুত্ব, অন্য দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবেশবিরোধিতা। জীবনের এই সাঁড়াশি-চাপ থেকে নিস্তার পেতেই বোধ হয় অনন্তলাল ঠাকুরকে ফিরে পড়া জরুরি।

এই বইয়ের শেষাংশে অনন্তলালকে নিয়ে নারায়ণ সান্যাল, সুবাস মৈত্রদের স্মৃতিচারণ আছে। কয়েক বছর আগে সারস্বত সমাজ থেকে বেরনো ‘অনন্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি’ বই থেকে সেগুলি পুনর্মুদ্রিত। সেই বই অবশ্য খুব কম ছাপা হয়েছিল। ফলে, পুনর্মুদ্রণে দোষ নেই। দুই মলাটে অনন্তলাল ঠাকুরের বাংলা নিবন্ধগুলি পাওয়া তো গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন