পুস্তক পরিচয় ২

তিনিও কি সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নেননি

হাংরি জেনারেশনের শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় বা শৈলেশ্বর ঘোষদের ‘আর্ট’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাটাকেই কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’ ঘোষণা করতে দেখি। ১৯৬১ সালে হাংরি জেনারেশনের প্রথম লিফলেটে এই আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ হিসেবে পরিচয়দাতা মলয় রায়চৌধুরী ১৯৬৪ সালেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share:

স‌ম্ভবত কলকাতা শহর থেকে দূরে পটনায় থাকার কারণেই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দুরপনেয় কোনও দুর্বলতা চোখে পড়ে থাকবে অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর দ্য ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট-এর তন্নিষ্ঠ এক পাঠকের। তাঁর মনে হল ‘যুক্তিবাদ ও রোমান্টিসিজম বাংলার শিল্পসাহিত্যকে রেখে গেছে এক খাঁ খাঁ প্রান্তরে’। বন্ধুরা মিলে আন্দোলনের কথা ভাবলেন। ইতিহাসের দার্শনিক স্পেংলার-এর এই বইয়ের একটি লাইন ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকেই পটনার মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের আন্দোলনের নাম ঠিক করেন ‘হাংরি জেনারেশন’। আর এই প্রসঙ্গেই অষ্টাদশ শতকে সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা-পদ্ধতির হস্তক্ষেপে নিশ্চিহ্ন সাব-অলটার্ন ডিসকোর্সটির কথা মনে পড়েছিল তাঁর। ‘ঔপনিবেশিক গর্ববোধ...’ নামের একটি প্রবন্ধে হাংরি আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ মলয় রায়চৌধুরী অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সেই সময়কার ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, কৃষ্ণকান্ত চামার, গোজলা গুঁই-দের কবিগানের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এক জন মুচিও সে সময় কবি হতে পারতেন।

Advertisement

দ্য মডার্ন সিস্টেম অব আর্ট/ আ কালচারাল হিস্ট্রি গ্রন্থে ল্যারি সিনার লিখেছেন, ‘আর্ট’কে বর্তমানে আমরা যে ভাবে দেখছি এটা কখনই ইতিহাসের কোনও সারাংশ বা ধারা নয়, এটা আমাদের বর্তমানের নির্মাণ। তাঁর কথায়, আর্ট বলতে আমরা এখন যা বুঝি তা আসলে ইয়োরোপের আবিষ্কার আর যার বয়স বড়জোর দু’শ বছর। কার্ল মার্ক্সের মতে, ‘আর্ট’ আসলে শ্রেণীবৈষম্য ব্যবস্থার ফলমাত্র, কম্যুনিস্ট সমাজে সাধারণ মানুষই ‘আর্ট’ সৃষ্টি করবে, ‘আর্টিস্ট’ বলে আলাদা কেউ থাকবে না। আর যেন তাই হাংরি জেনারেশনের শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় বা শৈলেশ্বর ঘোষদের ‘আর্ট’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাটাকেই কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’ ঘোষণা করতে দেখি।

প্রণব চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বইটি অবশ্যই পঞ্চাশ বছর আগেকার শিল্প-সাহিত্য জগতের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া আন্দোলনটিকে বোঝার পক্ষে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। হাংরি কবিদের কবিতা ও গদ্যের নিদর্শন ছাড়াও আছে হাংরি গ্রুপের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন কবির চিঠিপত্র, মলয়, সমীর রায়চৌধুরীদের প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার, হাংরি আন্দোলন নিয়ে শঙ্খ ঘোষ বা মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা প্রবন্ধ।

Advertisement

১৯৬১ সালে হাংরি জেনারেশনের প্রথম লিফলেটে এই আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ হিসেবে পরিচয়দাতা মলয় রায়চৌধুরী ১৯৬৪ সালেই এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা দেওয়া বা বিভিন্ন সঙ্গীর এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের সমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গেছে বলে তাঁর মনে হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই তাঁর সঙ্গীরা আদালতে সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেতে সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তিনিও কি নেননি? তিনি জানতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ কবিতাটিকে পছন্দ করেননি এবং সব জেনেও কেন মলয়বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে করে তাঁর খারাপ লাগা কবিতাটিকে বিচারকের সামনে ভাল বলে শংসাদানে অনুরোধ করেছিলেন? যে অনুরোধ সুনীল রেখেওছিলেন। নিজে বাঁচার জন্য বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অন্যকে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বলাটা কি কম সুবিধাবাদ? আর একটা কথা, ‘হাংরি প্রতিসন্দর্ভ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপীয় অধিবিদ্যাগত মনন বিশ্বের ফসল।’ তাঁর মনে পড়েছে মঙ্গলকাব্যগুলির কথা, তিনি লক্ষ্য করতে বলেছেন, ‘প্রাক ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই মাইক্রোপরিসরগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর রচয়িতারা নন।’ ওই একই লেখায় হাংরি আন্দোলনের শুরুর দিকে ফালি কাগজে প্রকাশিত রচনা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘রচনাগুলি দিলদরাজে বিলি করে দেয়া হত, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাক-ঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতা বোধের গর্ব।’ কিন্তু প্রথম লিফলেটে হাংরি আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ হিসাবে নিজের নাম ‘মলয় রায়চৌধুরী’ ছাপিয়ে মলয়বাবু নিজে কি ভারতীয় নশ্বরতা বোধের উদাহরণ রাখতে পেরেছিলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন