পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

শিল্প ও সংগীতে জীবনের অঙ্গীকার

বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী, প্রয়াত কাইয়ুম চৌধুরী ৬৫ বছর ধরে চিত্র চর্চার মধ্য দিয়ে স্বকীয় এক চিত্রভাষা নির্মাণ করেন। প্রচ্ছদ এবং সচিত্রকরণেও তাঁর সিদ্ধি ও উত্তরণ বিস্ময় জাগায়। এ ক্ষেত্রে তিনি ভাবীকালের জন্য একক প্রচেষ্টায় আধুনিকতার এক পথ নির্মাণ করে দিয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

আবুল হাসনাত

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

জীবনে আমার যত আনন্দ। কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথমা প্রকাশন, ২৫০.০০।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী, প্রয়াত কাইয়ুম চৌধুরী ৬৫ বছর ধরে চিত্র চর্চার মধ্য দিয়ে স্বকীয় এক চিত্রভাষা নির্মাণ করেন। প্রচ্ছদ এবং সচিত্রকরণেও তাঁর সিদ্ধি ও উত্তরণ বিস্ময় জাগায়। এ ক্ষেত্রে তিনি ভাবীকালের জন্য একক প্রচেষ্টায় আধুনিকতার এক পথ নির্মাণ করে দিয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

তাঁর আলোচ্য বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘মনের মতো ছবি’তে পাঁচটি, দ্বিতীয় অধ্যায় ‘উজ্জ্বলতম জীবন’-এ নয়টি এবং ‘কত আনন্দ, কত তৃপ্তি’ অধ্যায়ে আটটি রচনা আছে। প্রতিটি রচনায় বিষয়ের গুণে ও গদ্যের স্বাতন্ত্র্যে তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টি ভিন্ন মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর জীবন ছিল বর্ণময়, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ। বাংলাদেশের সংস্কৃতির যাত্রাপথ, বিশেষত চিত্র আন্দোলন প্রয়াসের বৈচিত্রময় ভুবন এবং নানা নিরীক্ষা জানার জন্য এই গ্রন্থটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

প্রবন্ধগুলিতে আছে শিল্প ও সংস্কৃতি, সতীর্থ শিল্পী, মাস্টারমশাই-সহ শিল্পবিষয়ক নানা ভাবনা। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপ, শিল্পের ভুবন ও অন্বিষ্ট খুব সহজে উপলব্ধি করা যায়। যেমন ‘নদী আমাকে ডাকে’, লেখাটিতে বাল্যস্মৃতির সঙ্গে মিশেছে চিত্র সাধনায় নদী ও নিসর্গের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা, ছেলেবেলার নদী যে পরিণত বয়সেও তাঁকে কত ভাবে প্রভাবিত করেছে, আছে সে কথা।

Advertisement

একটি প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের সূচনার কথা বলেছেন। সেই সময়ের পরিবেশ এবং কোন পারিবারিক বৃত্ত থেকে রুচির পরিগ্রহণ হয়েছিল, তা বর্ণনা করেছেন। আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া ও পরে আচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও সফিউদ্দিন আহমেদ, উন্নত রুচির এই ত্রয়ী মাস্টারমশাই তাঁদের সৃজন ও শিল্পাদর্শ দ্বারা কেমন করে একটি দেশের শিল্প-আন্দোলনকে নানা দিক থেকে শিখরস্পর্শী করে তুলেছিলেন, তাঁর বর্ণনা পড়তে আশ্চর্য লাগে। এই মাস্টারমশাইরাই বাংলাদেশের ১৯৪৭-পরবর্তী চিত্র আন্দোলনের ভিত নির্মাণ করেছিলেন। তাঁরা কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে যে শিক্ষাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন, নবগঠিত রাষ্ট্রের চিত্রকলা প্রয়াসে সেই শিল্পাদর্শ ও শিল্পবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন। তাঁরা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার মধ্যে চিত্রকলার ক্ষেত্রটিতেই সর্বাধিক প্রাণময় হয়ে উঠেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর এ বই পাঠ করলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সন্‌জীদা খাতুন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী; ছায়ানট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও রবীন্দ্র-গবেষক। রবীন্দ্রগানেরও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনে তিনি অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচিত রবীন্দ্র বিষয়ক বেশ কয়েকটি বই সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের আবশ্যিক হিসেবে পঠিত হচ্ছে।

তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থ রবীন্দ্র বিশ্বাসে মানব অভ্যুদয়। ৮৪ বছর বয়সেও রবীন্দ্রনাথের গান, বাণী, সুর নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণে তিনি কিছু কথা বলতে চেয়েছেন। তাঁর ভাবনা ও সামাজিক বৃত্ত যে কত ব্যাপক, প্রখর ও স্বচ্ছ, প্রধানত রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচিত এই গ্রন্থে তা প্রতিভাত হয়।

রবীন্দ্রসংগীত আর বাংলাদেশের গানের ভুবন, মুক্তিসংগ্রাম, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সাথী ও রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের পথের দিশারি— বইয়ের এই চারটি প্রবন্ধের বিভাব একসূত্রে গাঁথা। কোনও জাতীয় সংকটকালে রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথ কেমন করে বাংলাদেশের বাঙালির জন্য অপরিহার্য ও সংকট উত্তরণে সহায়ক হয়ে ওঠে, সন্‌জীদা খাতুনের বর্ণনায় তা এক প্রত্যয় নিয়ে উল্লেখিত হয়েছে।

১৯৭৫-এ রাজনৈতিক পট বদলের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মৌলবাদী উত্থানের ফলে বিশেষত শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ক্ষেত্রেও নানামুখী সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের যে-ক’জন সৃজনশীল মানুষ এই সংকট উত্তরণের জন্য বাঙালির সংস্কৃতির চর্চাকে অব্যাহত ধারায় নিত্য নবীন মাত্রা সঞ্চারে উন্মুখ ও নানা কর্মে ব্যাপৃত আছেন, সন্‌জীদা খাতুন তাঁদের অন্যতম। এই গ্রন্থে এই সংকট সম্পর্কে যেমন আলোকপাত আছে, তেমনই তার নিরসনে রবীন্দ্রনাথের মনুষ্যত্ববোধ, বিশ্বানুভূতি ও সামগ্রিক মঙ্গলচেতনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সাধনার গতিমুখে কী ভাবে প্রাণময় আশ্রয় হয়ে সংস্কৃতিচর্চায় ও জীবনবোধে রসসঞ্চার করছে, তিনি বারবার তা উল্লেখ করেছেন। ‘ছায়ানট’ কোন পটভূমিকায় গঠিত হয়েছিল, আছে সে প্রসঙ্গটিও। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সংখ্যাতত্ত্ববিদ ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তাঁর পিতা। তিনি ছিলেন শিখা গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য। তাঁর ঔদার্যগুণ, সংগীতানুরাগ ও বিজ্ঞানমনস্কতা পরিবারে ছাপ ফেলেছিল। এই গ্রন্থে সংগীতের প্রতি ও সামাজিক দায়ের যে ছবি পাই, তা হয়ে ওঠে বিরূপ প্রতিবেশেও তাঁর সমগ্র জীবনের অঙ্গীকারলগ্ন প্রাণবন্ত এক অনুষঙ্গ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন