চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

সৌন্দর্য নয়, বিপর্যয়ের ভাবনাও প্রকাশিত

সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত জয়শ্রী চক্রবর্তীর প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষজয়শ্রী চক্রবর্তীর ছবির বা শিল্পকাজের মুখ্য বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতি। প্রকৃতির সৌন্দর্য ততটা নয়। তার চেয়ে বেশি এই সৌন্দর্যের বিপর্যয় নিয়ে তাঁর ভাবনা। আজকের বিশ্ব-সভ্যতা মানুষকে অনেক দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাকে ধ্বংসের পথেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

শিল্পী: জয়শ্রী চক্রবর্তী

জয়শ্রী চক্রবর্তীর ছবির বা শিল্পকাজের মুখ্য বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতি। প্রকৃতির সৌন্দর্য ততটা নয়। তার চেয়ে বেশি এই সৌন্দর্যের বিপর্যয় নিয়ে তাঁর ভাবনা।

Advertisement

আজকের বিশ্ব-সভ্যতা মানুষকে অনেক দিয়েছে। সেই সঙ্গে তাকে ধ্বংসের পথেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন মানব-সভ্যতার পরবর্তী ধ্বংস নেমে আসবে মানুষের অদূরদর্শিতায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে। একজন শিল্পী হিসেবে এবং একজন মানবী হিসেবে জয়শ্রী এরই বিরুদ্ধে তাঁর ভাবনাকে ব্যক্ত করতে চান।

সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল তাঁর সাম্প্রতিক কাজের একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘আনফোল্ডিং কুচিনান’। কলকাতার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত আজকের সল্টলেক এক সমৃদ্ধ উপনগরী। এ অঞ্চলের প্রাক্তন পরিবেশকে ধ্বংস করে কীভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ও প্রসারিত হচ্ছে এই উপনগরী তারই এক দৃশ্য ইতিহাস গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী।

Advertisement

১৯৫৮ সাল থেকে সল্টলেকের নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১৮৫২ সালের কলকাতার মানচিত্রে এই অঞ্চলকে ‘কুচিনান’ বলে দেখানো ছিল। সেই ‘কুচিনান’-এর ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আরও আগে। ১৭৩৭ সালের ভূমিকম্প ও ঝড় এ অঞ্চলকে বিপর্যস্ত করেছিল। বিদ্যাধরী নদী স্রোতহীন হয়ে গিয়েছিল। এই নদীর স্মৃতিচিহ্ন আজও সল্টলেক অঞ্চলে রয়ে গেছে।

তবু এই জলাভূমি কলকাতার প্রাণধারণের পক্ষে অনেকটাই সহায়ক ছিল। আজ এই অঞ্চলের নগরায়নের প্রসার সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্যকে ক্ষত-বিক্ষত করছে।

জয়শ্রী তাঁর ১৪-টি ছবিতে ‘কুচিনান’-এর সেই স্মৃতি থেকে শুরু করে এই ধ্বংসের ইতিবৃত্তকে উন্মোচিত করেছেন। তাঁর ছবিগুলি নির্মাণধর্মী। স্ট্রাকচাকরাল বা গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের উপর তিনি জোর দিয়েছেন। প্রকৃতির যথাযথ রূপকে তুলে ধরেননি। তার সংকটকে বোঝাতে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। সে দিক থেকে তাঁর রূপায়ণ পদ্ধতি স্বাভাবিকতাবাদী বা অভিব্যক্তিক নয়, বলা যেতে পারে ‘কনসেপচুয়াল’।

জয়শ্রীর জন্ম ত্রিপুরায় ১৯৫৬ সালে। শৈশবে প্রকৃতির সৌন্দর্য ও উদাত্ততায় আবিষ্ট ছিলেন তিনি। সেই সৌন্দর্যের বিলয় আজ তাই তাঁকে ব্যথিত করে। তাঁর শিল্পশিক্ষা স্নাতক স্তরে বিশ্বভারতীতে, স্নাতকোত্তর স্তরে বরোদায়।

বিশ্বভারতী তাঁকে রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের নিসর্গের অনুধ্যানের ভিতর দিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বরোদা তাঁকে সাহায্য করেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংশ্লেষে।

১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সে ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স’ হিসেবে কাজ করেছেন। উত্তর-আধুনিক ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সেখানে। এই সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব রূপভঙ্গি। ১৯৮৩-তে তাঁর প্রথম এককে নিসর্গ ও অবয়বের যে সমাহার ছিল, সেই সারল্যকে তিনি ক্রমে গাঠনিকতার দিকে নিয়ে গেছেন।

‘লস্ট লেক আন্ডার দ্য সিটি’ ছবিতে আয়তাকার চিত্রক্ষেত্রের মধ্যে তিনি একটি ত্রিকোণ পরিসর তৈরি করেছেন, যেখানে রয়েছে গড়ে ওঠা শহরের জমাট অট্টালিকাশ্রেণী। মাঝখানে একটি ছোট চতুর্ভুজ। চারপাশে পরিব্যাপ্ত লুপ্ত হয়ে যেতে থাকা জলভূমির স্মৃতিকে যেন ধরে রেখেছে।

ছবিটির নির্মাণে শিল্পী ব্যবহার করেছেন তুলোর কাপড়, নেপালি কাগজ, পাট, ঘাস, শুকনো পাতা, মাটি, আঠা, চায়ের ছোপ ইত্যাদি নানা উপকরণ।

বিদ্যাধরী নদীর অবশেষ নিয়ে রয়েছে একটি ছবি। সেটিও পূর্বোক্ত মাধ্যমেই আঁকা। নিসর্গের বিমূর্ত উচ্চাবচতার মধ্যে একটি জলস্রোত কিছুটা প্রবাহিত হয়ে হারিয়ে গেছে। ‘ইন দ্য ভেরি ফেস অব টাইম’ ছবিতে বিমূর্তায়িত নিসর্গের ভিতর একটি মুখ ভেসে আছে। যেন কালের স্মৃতির প্রতীক।

‘মুডস অব ওয়াটার’ ছবিটি ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে আঁকা। যে জল ছিল এক দিন, আজ যা প্রায় সম্পূর্ণ বিমূর্ত হয়ে গেছে, সেই জলের স্মৃতি-উদ্ভাসিত বিমূর্ত নিসর্গ তৈরি করেছেন শিল্পী।আলোছায়ার দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে এক করুণ সুরের ঝংকার বেজে ওঠে। হারিয়ে যাওয়ার এই করুণা তাঁর এই চিত্র-প্রকল্পের মূল সুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন