পুস্তক পরিচয় ১

তত্ত্ব-তথ্য ছাড়িয়ে গভীর নৈতিক আর্তি

বই দু’টির আয়তন ও শিরোনাম পাঠককে ঘাবড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দৈনিক পত্রিকার সীমিত পরিসরে এই ধরনের রচনাসমগ্র (নির্বাচিত প্রবন্ধ নয়) পর্যালোচনা করতে গিয়ে লেখকের প্রতি সুবিচার করতে পারা গেল কি না, সে ব্যাপারে একটা দুশ্চিন্তা রয়েই গেল; বিশেষত লেখক যেখানে সৌরীন ভট্টাচার্যের মতো স্বনামধন্য চিন্তাজীবী।

Advertisement

শোভনলাল দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

সৌরীন ভট্টাচার্য: রচনা সংগ্রহ। খণ্ড ১-২। অভিযান পাবলিশার্স, যথাক্রমে ৯৫০.০০ ও ১০০০.০০

বই দু’টির আয়তন ও শিরোনাম পাঠককে ঘাবড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দৈনিক পত্রিকার সীমিত পরিসরে এই ধরনের রচনাসমগ্র (নির্বাচিত প্রবন্ধ নয়) পর্যালোচনা করতে গিয়ে লেখকের প্রতি সুবিচার করতে পারা গেল কি না, সে ব্যাপারে একটা দুশ্চিন্তা রয়েই গেল; বিশেষত লেখক যেখানে সৌরীন ভট্টাচার্যের মতো স্বনামধন্য চিন্তাজীবী। বিপদটা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি, কারণ খণ্ডগুলিতে আসলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গোটা গোটা কয়েকটি বই, যেগুলির ভিত্তিভূমি হল, গত কয়েক দশক জুড়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ, আলাপচারিতা, গ্রন্থ পর্যালোচনা ইত্যাদি অনেক কিছুই। সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্পকলা, কোনও কিছুই তাঁর নজর এড়ায়নি। আর বিষয়বস্তুর এই ব্যাপ্তির কারণে লেখাগুলি এক দিকে যেমন চিন্তা উদ্রেককারী, অপর দিকে সেগুলির পাঠ অনেক ক্ষেত্রে বেশ শ্রমসাধ্যও বটে। এই বই-এর মধ্যে বইগুলিতে রয়েছে রল্‌স-হাবেরমাস বিতর্ক, বিধবাবিবাহ নিয়ে বিদ্যাসাগরের বক্তব্য ও তাকে ঘিরে কূটতর্ক এবং তার বিচার-বিশ্লেষণ, অমর্ত্য সেনের মঙ্গলকামী অর্থনীতি, বিজ্ঞানভাবনার দার্শনিক বিচার, হিন্দুত্ব ও সেকুলারিজম, বঙ্গসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক, অর্থনীতি বিষয়ক তত্ত্বভাবনা এবং আরও অনেক কিছু। বলা বাহুল্য, শব্দসীমাকে মান্যতা দিয়ে এত সব বিষয়ের আলোচনা পুরোদস্তুর করা সম্ভব নয়। এই পর্যালোচনাকে তাই সীমিত রাখতে হচ্ছে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের আলোচনার মধ্যে, যথা— সমাজতন্ত্রের সংকট ও পতন, উন্নয়নভাবনা এবং আধুনিকতার স্বরূপ। ওজনে এগুলো সবই রীতিমত ভারী প্রবন্ধ ও আঙ্গিকের বিচারে গভীর ভাবে তাত্ত্বিক। অপেক্ষাকৃত হালকা মেজাজে লেখা, কিছুটা রিপোর্টাজের ভঙ্গিতে, একগুচ্ছ রচনা পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলির অন্তর্বস্তু দেশীয় ও কিছুটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির সুলুক সন্ধান।

Advertisement

সমাজতন্ত্র দিয়েই শুরু করা যাক। লেখক সমাজতন্ত্রের প্রতি গভীর ভাবে আস্থাশীল, ‘মাদকাসক্ত পুঁজিবাদ’-এর বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্রকেই তিনি মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ হিসেবে গণ্য করেন, কিন্তু তার ভিত্তিভূমি হিসেবে খোঁজ করেন যে মানবতাবাদ, বহুত্ববাদ ও শ্রমজীবী মানুষের সক্রিয় গণউদ্যোগের, তার কোনও হদিশ তিনি পান না, সোভিয়েত ধাঁচে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কেন্দ্রিকতাধর্মী সমাজতন্ত্রের যে মডেল, তার মধ্যে। এটাই অদৃষ্টের পরিহাস যে, জনগণের স্বায়ত্তশাসন, সোভিয়েতগুলির ক্ষমতায়ন, লেনিনের এই গোড়ার দিকের ভাবনাকে শেষ পর্যন্ত গ্রাস করল কাউটস্কি ও প্লেখানভের প্রায় দৃষ্টবাদী মার্কসবাদের একরৈখিক ভাষ্যটি, যার বিরুদ্ধেই কামান দেগেছিলেন লেনিন। ফলে পিছু হটল মানুষ, জেঁকে বসল পার্টিতন্ত্র। ইউরোকমিউনিজমের পথ বেয়ে বুখারিন থেকে গোরবাচেভ, যাঁরা সমাজতন্ত্রের এক বিকল্প ভাষ্য প্রদানে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরা কেউই কল্কে পেলেন না, সমাজতন্ত্রের এও এক ট্র্যাজেডি। পূর্ব গোলার্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যে কর্মসূচি মাও গ্রহণ করলেন, সেটিও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হল, কারণ পার্টির আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালো আঘাত হেনেও এটি কোনও বিকল্প সংস্কৃতির দিশা দেখাতে পারল না (খণ্ড ১, পৃ. ৮৩)।

উন্নয়নের প্রশ্নটি নিয়ে রয়েছে একগুচ্ছ প্রবন্ধ, যার মূল কথা একটিই: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়ন ও মানব উন্নয়ন— এই দু’টি ছাঁদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনও বিরোধ না থাকলেও শেষ পর্যন্ত অপসৃত হয়ে যায় মানবমুখিতা, সমাজমনস্কতার ভাবনা। তাই, বারে বারেই উঠে এসেছে বিশ্বব্যাঙ্ক, ভুবনায়ন, সাহা-মহলানবিশ কৃত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর মডেল, উচ্চারিত হয়েছেন অমর্ত্য সেন। লেখাগুলি কয়েকটি বিষয়ে আমাদের ভাবনাকে উসকে দেয়। এক: উন্নয়নের তথাকথিত প্রযুক্তিসর্বস্ব মডেলটি, যার ইজারা নিয়েছে নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতি, একেবারেই সমাজের উপরতলার অর্থনীতির প্রতিফলন, যা খোঁজ রাখে না সুষম উন্নয়নের ভাবনার। দুই: সমাজতন্ত্রেও ভিন্ন প্রেক্ষিতে অনেকটা এমন ব্যাপারই ঘটেছিল। ভারী ও দ্রুত শিল্পায়নের নামে প্রশ্রয় পেয়েছিল শক্তি প্রদর্শনকারী এক কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা; যেখানে উপেক্ষিত হয়েছিল কৃষি, জনগোষ্ঠীগত ভিন্নতা ও বহুস্তরীয়তার ভাবনা। তিন: উন্নয়নের একমুখী দৃষ্টিভঙ্গি যে মহাকাহিনির জন্ম দেয়, তার সামূহিকতা খর্ব করে ‘সারূপ্যে’-র ভাবনাকে। ‘সারূপ্যের রাজনীতি’, যার বহুমাত্রিকতা (জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা ইত্যাদি) আজ গোটা দুনিয়ারই এক বড় সমস্যা, তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমগোত্রীয় আখ্যা দেওয়া তাই মোটেই সমীচীন হবে না, যদিও তার বিপদের সম্ভাবনাকেও লেখক অস্বীকার করেননি (খণ্ড ২, পৃ. ৪১৪-১৫)। চার: উন্নয়নের এই ভাবনা সম্পূর্ণ বিসর্জন দেয় নৈতিকতার ভাবনাকে, মানুষের মঙ্গলচিন্তাকে।

Advertisement

এরই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপর বিষয়টি হল আধুনিকতার ভাবনা, যেটি এই রচনাসংগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মহাআখ্যান, উত্তর-আধুনিকতা, ভিন্নতা ইত্যাদি ধারণাগুলি নিয়ে আলোচনার ব্যাপ্তি রেনেসাঁস থেকে রামমোহন, পশ্চিমি আধুনিকতা থেকে আমাদের সময়কাল। ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাবনা এক ধরনের বলদর্পী একরৈখিকতাকে বৈধতা দেয় ও অস্বীকার করে ভিন্নতার ভাবনাকে— উত্তর-আধুনিকতার জারি করা এই সতর্কতাকে মান্যতা দিয়েও লেখক এ কথাটাও কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘যদি কোনো সামান্যধর্ম না থাকে, তা হলে তো আধুনিকতা বলেই কোনো কিছু ধরা যাবে না। এবং এই ভিন্নতাকেই খুব বড় করে দেখতে গেলে আমরা এক সময়ে আধুনিকতার ধারণাকেই হয়তো বিসর্জন দিয়ে বসব।’ (খণ্ড ২, পৃ. ৪৩১) অর্থাৎ, আপেক্ষিকতার ভাবনার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু চূড়ান্ত আপেক্ষিকতা সর্বনেশে।

তবে পাঠকের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। লেখক একটি নিজস্ব বানানপদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তা ছাড়া তিনি ইংরেজি হরফকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে বাংলা বানানই ব্যবহার করেছেন। উদ্দেশ্য অবশ্যই সাধু। কিন্তু ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় বিভিন্ন শব্দ বাংলা হরফে লিখতে গিয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছে, ঘটেছে মুদ্রণপ্রমাদও। পাঠক এমন কিছু নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হবেন, বাংলা ভাষায় সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষা নির্মাণে আগামী দিনে যা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। আরও একটি কথা। তিনি উসকে দিয়েছেন অনেক ভাবনা, প্রশ্ন তুলেছেন হরেক কিসিমের, কিন্তু চটজলদি কোনও সমাধানসূত্র দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। এক ধরনের অসম্পূর্ণতার ভাবনা অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে যেন তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রায় স্বগতোক্তির সুরে মাঝেমধ্যেই তাঁর অভিব্যক্তিটি ধরা পড়েছে দু’টি শব্দচয়নের মধ্যে: ‘কে জানে’! পাঠককে আরও খেয়াল রাখতে হবে যে, লজিক ও বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ এবং অর্থনীতিশাস্ত্রে পেশাগত ব্যুৎপত্তি— এ সবের সুবাদে তাঁর লেখনী ঠাসবুনট, আবেগবর্জিত, তত্ত্বগন্ধী। ইংরেজিতে এমন লেখার সঙ্গে আমাদের প্রায়ই পরিচয় ঘটলেও বাংলায় তেমনটি পাওয়া বেশ ভাগ্যের ব্যাপার। লেখাগুলোকে তাই রীতিমত মাথা দিয়ে পড়তে হয়। একই সঙ্গে এই রচনা সংগ্রহে নিহিত রয়েছে এক গভীর নৈতিক আর্তি— নিছক তত্ত্ব বা তথ্যসর্বস্বতা নয়।

তবে একটা অনুযোগ রইল প্রকাশককে নিয়ে। ভট্টাচার্য মহাশয় প্রথম খণ্ডের শুরুতেই বলে দিয়েছেন যে, এই সংকলন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও দায় নেই। সেই কারণে বিশেষ প্রয়োজন ছিল যথোপযুক্ত সম্পাদনার ও একটি সম্পাদকীয় ভূমিকার। মুদ্রণপ্রমাদ ছাড়াও আরও কিছু সমস্যা তা হলে এড়ানো যেত। সূচিপত্রের বিন্যাস ও প্রকাশনার সময়কালের ক্ষেত্রে দু’টি খণ্ডের মধ্যে অসঙ্গতি, প্রবন্ধগুলির শেষে সময়কাল উল্লিখিত হলেও মূল সূত্রটির অনুপস্থিতি, প্রথম খণ্ডে খণ্ড সংখ্যার অনুল্লেখ ইত্যাদি এত উচ্চ মানের রচনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছনীয় ছিল। নিশ্চয়ই আশা করব যে, এই রচনাসম্ভার সম্পূর্ণ হতে আরও বেশ কয়েকটি খণ্ডের প্রয়োজন হবে। এই ত্রুটিগুলো তখন শুধরে নিলে ভাল হয়। আপাতত পথ চেয়ে আগামী খণ্ডগুলির প্রতীক্ষায় রইলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন