book review

জেগে থাকে নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর

নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর সেবন্তীর সবচেয়ে বড় জোর। পরিমিতি বোধ, তীব্র অনুভূতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া তাঁর গল্পকে অন্য মর্যাদা দিয়েছে।

Advertisement

ঈশা দেব পাল

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:৪২
Share:

এই সময়ের একাধিক সামাজিক বিক্ষিপ্ততার পটভূমিতে, এবং একই সঙ্গে মেয়েদের ‘নিজের ভাষা’ অর্জন করার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক ‘নারী লেখক’-এর লেখায় কি অবশ্যম্ভাবী হবে পক্ষপাত? পুরুষ-বিদ্বেষ? বিশেষত কোনও গল্প সঙ্কলনের লেখক যদি নারী হন, বইটি উৎসর্গে যদি থাকে সমসাময়িক দুই নারী লেখক, এবং বইটির ভূমিকা যদি লেখেন এই সময়ের আর এক বিশিষ্ট নারী লেখক? সেবন্তী ঘোষের গল্প সঙ্কলন শ্লোক ও অন্যান্য গল্প এই সমস্ত প্রশ্ন এবং সন্দেহের মধুর নিরসন ঘটায়। নারী মন, নারী অভিব্যক্তি, বালিকাবেলা, যৌবনবেলা, প্রেম কিংবা আতঙ্কও আশ্চর্য প্রসাদগুণ নিয়ে ধরা দেয় এক-একটি গল্পে। জীবন বড় হয়ে ওঠে তার নিজস্ব সামঞ্জস্যের ছন্দে। তাতে মিশে থাকে এক সরল ঔৎসুক্যময় মননশীলতা।

Advertisement

লেখকের গল্প জুড়ে থাকে প্রকৃতি— পাহাড়, গাছ, কোপাই কিংবা হারিকেন-জ্বালা সন্ধে। আশির দশকের সেই সব অপাপবিদ্ধ মফস্‌সলি দিন ও রাতের সারল্যে লেখক বুনেছেন তাঁর একাধিক গল্প, সারল্যের মাধুর্য যেখানে লেগে থাকে কিশোরীবেলার মতোই।

‘বর্ষামঙ্গল’ কিংবা ‘মেঘলা’ গল্পগুলি পাঠককে টাইম ট্রাভেল করে নিয়ে যায় সেই জ্যোৎস্না ছড়ানো লাল খোয়াইয়ের তীরের শান্তিনিকেতনে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে থাকেন কিশোর-কিশোরীদের মনে ও যাপনে। সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনের স্বাদ লেখক এত মায়াবী টানে আঁকেন যে, গল্প দু’টিকে কলাভবনের বাগানে এঁকে ফেলা এক দীর্ঘ জলরঙা নিসর্গচিত্র মনে হয়, যেখানে উদাসী প্রেমিক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে পরীক্ষায় না বসে চলে যায় কোপাইয়ের ধারে, আবার একই হারিকেনে গোল করে অঙ্ক করতে বসে শ্রীসদনের মেয়েরা। ‘মেঘলা’ গল্পের অকালমৃত্যুর থেকেও বেশি আবেদন নিয়ে জেগে থাকেন রবীন্দ্রনাথ— রবীন্দ্রদর্শনমুখর এই জীবনও।

Advertisement

শ্লোক ও অন্যান্য গল্প

সেবন্তী ঘোষ

২৬০.০০

দে’জ

‘হৃদয়’ নামের গল্পটিতে চরিত্রের নাম ও গল্পের ব্যঞ্জনা মিলেমিশে যায়। এই নিষ্ঠুর গল্পটির বুননে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা— একটি মেয়ের উপর তার সৎ বাবার অত্যাচার, হিরের কুচির নাকছাবি পরা এক দুঃখী মেয়ে এবং তাকে সাহায্য করতে চাওয়া না-চাওয়া— নিম্নবিত্ত ঘরের, লড়াই করা এক সাংবাদিক, যার নাম হৃদয়। এ সমস্ত ঘটনা-দুর্ঘটনা গল্পটিতে উঠে আসে সংবাদ পরিবেশনের ধরনেই। এমনকি মেয়েটির ‘কেস’ সামলাতে গিয়ে নাম করে ফেলা হৃদয়ের ‘স্টেটাস’-এর পরিবর্তনও লেখা হয় এক শান্ত পরিমিত ভঙ্গিতে, মনোযোগী পাঠক পড়তে পড়তে শিহরিত হবেন। ঠিক একই রকম শিউরে উঠতে হয় ‘হাসির গল্প’ পড়তে গিয়েও। কান্না কিংবা অপমানের অনুভূতিমালা লেখক লিখে ফেলেন এতটুকু উচ্চকিত না হয়ে, নান্দনিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে। সে জন্যই ‘হাসির গল্প’ সার্থক কান্নার গল্প।

নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর সেবন্তীর সবচেয়ে বড় জোর। পরিমিতি বোধ, তীব্র অনুভূতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া তাঁর গল্পকে অন্য মর্যাদা দিয়েছে। একাধিক গল্পে উঠে এসেছে এক বৃহৎ পটভূমি, চরিত্ররা হয়েছে তুচ্ছ। ‘আমি ও সামারা’ গল্পটিকে মনে হয় যেন এক ক্লাসিক ফিল্মের অংশ। ‘বাঘ’, ‘ঘাতক’ কিংবা ‘অনুমাসিরা’— এই গল্পগুলিতেও তীব্র অনুভূতিপরায়ণ মানুষের টানাপড়েন ক্রমশ সার্বিক হয়ে ওঠে। গল্পের চরিত্রগুলির সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে গিয়েছে বাস্তবের চেনা একাধিক পরিপ্রেক্ষিত। তবে এই সঙ্কলনে সবচেয়ে আশ্চর্য এবং চমকপ্রদ বলে মনে হয়েছে ‘গন্ধ’ এবং ‘অনুসরণকারী’ গল্প দু’টিকে। ভাব ও ভাষার হাত-ধরাধরিতে নারীমনের প্রেম-দ্বেষ-আতঙ্ক সবই উঠে এসেছে নিখুঁত ভাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন