Book Review

সদিচ্ছা আছে, যত্নটুকু নেই

প্রথম প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চা করতে হলে ভাষার প্রতি ন্যূনতম যত্নের দরকার হয় না কি? সাকুল্যে সাড়ে তিন পৃষ্ঠার ‘সম্পাদকীয়’ নামাঙ্কিত লেখাটিতে ভুলের সংখ্যা গুনতে হলে অচিরেই ধৈর্য হারাতে হয়।

Advertisement

নির্মল পাত্র

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ০৬:২৬
Share:

রাজনীতিক, সমাজকর্মী, গল্পকার, বাচিক শিল্পী— অনেকগুলি পরিচয়ে ভূষিত এক নাগরিক ‘সময়ের দাবি’ মেনে বাংলা ভাষায় কার্ল মার্ক্স বিষয়ক একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন সম্পাদনা করেছেন। উদ্দেশ্য সাধু। তবে কিনা, কেবল উদ্দেশ্য দিয়ে বাক্য সম্পূর্ণ হয় না, বিধেয়ও চাই। শ’আড়াই পৃষ্ঠার এই বইটি নিয়ে সেখানেই কিছু প্রশ্ন ওঠে।

Advertisement

প্রথম প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় বিদ্যাচর্চা করতে হলে ভাষার প্রতি ন্যূনতম যত্নের দরকার হয় না কি? সাকুল্যে সাড়ে তিন পৃষ্ঠার ‘সম্পাদকীয়’ নামাঙ্কিত লেখাটিতে ভুলের সংখ্যা গুনতে হলে অচিরেই ধৈর্য হারাতে হয়। বহু ‘তাঁর’ এবং ‘তাঁদের’ বেমালুম ‘তার’ এবং ‘তাদের’ হয়েছে, সেই অমর্যাদা না-হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, ‘জাত্যভিমান’ যে ‘জাত্যাভিমান’ হবে সেটাও বোধ করি যুগের হাওয়া, কিন্তু উদ্ভুত (উদ্ভূত), কৈশোরীত্তীর্ণ (কৈশোরোত্তীর্ণ), নিষ্পেশিত (নিষ্পেষিত)...? এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস হয়ে যাবেন ‘ফ্রেডরিয়া’? বাকি বই? দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়েই এ-প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। একটি লেখায় চোখে পড়ল ‘বাকুনির উদ্যোদ’, অর্থাৎ বাকুনিনের উদ্যোগ। একটি লেখার উৎস স্বীকারে লেখা হয়েছে ‘দেলহিতৈষী’ পত্রিকার নাম। আজ্ঞে হ্যাঁ, দেশহিতৈষী।

এমন অযত্ন সচরাচর কেবল ভাষায় ও বানানে সীমিত থাকে না, এ ক্ষেত্রেও থাকেনি। মার্ক্সের নির্বাচিত জীবনপঞ্জি এবং রচনা-পরিচিতি বাদ দিয়ে এই সঙ্কলনে আছে নানা পত্রপত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত উনিশটি প্রবন্ধ। তার মধ্যে পাঁচটি নেওয়া হয়েছে মার্ক্সের জন্মের দেড়শো বছর পূর্তিতে প্রকাশিত এক্ষণ পত্রিকার (১৯৬৮) ঐতিহাসিক এবং বহু-আলোচিত সংখ্যাটি থেকে। এ ছাড়াও আছে মার্ক্সের মৃত্যুর শতবর্ষ উপলক্ষে অমর্ত্য সেন রচিত একটি লেখার ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ (অনুবাদকের নাম, অনুমান করা যায়, মৃণালকান্তি ভদ্র, তবে ছাপা হয়েছে মৃণালন্তি!)

Advertisement

এ ধরনের একটি সঙ্কলনে সাম্প্রতিক লেখার পাশাপাশি প্রাচীন কিছু প্রবন্ধ রাখা যেতেই পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে একটা পারম্পর্য রাখতে হয়। সময়ের পরম্পরা অনুসরণ করা যায়, অথবা বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস করে নেওয়া যায়। সেই কারণেই এই ধরনের সম্ভারে সচরাচর কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক বিভাগ তৈরি করে নেওয়া হয়, যে বিন্যাস নিয়ে সম্পাদকের ভূমিকায় কিছু কথা বলা থাকে। এ বইয়ের লেখাগুলি পর পর ঢেলে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিন্যাসের কোনও সূত্র যদি থেকেও থাকে, সম্পাদক তা ঘুণাক্ষরেও জানাননি।

তার পরেও এই সঙ্কলন কয়েকটি লেখার জন্য দেখার যোগ্য। যেমন, বিশেষ করে, শোভনলাল দত্তগুপ্তের ‘মার্কসবাদ ও আমরা’, তপন মিশ্রের ‘বাস্তুতন্ত্র: মার্কস-এঙ্গেলস এবং কিছু সমকালীন ভাবনা’, মালিনী ভট্টাচার্যের ‘সংস্কৃতির লড়াই’, শুভময়ের ‘কার্ল মার্কস ও তাঁর রুশ সাহিত্য পাঠ অথবা পাঠবিনিময়ের এক উপকথা’ (শিরোনাম কিঞ্চিৎ ভীতিপ্রদ হলেও লেখাটি মূল্যবান)। আর, পুরনো চাল তো ভাতে বাড়েই, যেমন সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কার্ল মার্কস ও অ্যালিয়েনেশন’, ইরফান হাবিবের সংক্ষিপ্ত ‘ভারত ও মার্কস’, ঋত্বিক ঘটকের রাজনৈতিক দলিল ‘কমিউনিস্ট শিল্পীরা এবং পার্টি’, অনুবাদের আড়ষ্টতা অতিক্রম করতে পারলে অমর্ত্য সেনের স্বকীয় প্রজ্ঞা।

দুনিয়া জুড়ে মার্ক্স চর্চা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষাতেও গত কয়েক বছরে এই বিষয়ে নতুন প্রাণের সাড়া মিলেছে। সেই ধারায় যোগ দেওয়ার সদিচ্ছা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তার সঙ্গে ঈষৎ যত্ন চাই, আর চাই পরিশ্রম। চিন্তার পরিশ্রম।

চর্চায় মার্কস

সম্পাদনা: রতন বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৫০.০০

রূপালী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন