ও দিকে বট এ দিকে তেঁতুল

দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের সরু গলিটা পেরলেই সামনে ছবির মতো ফুটে ওঠে ছয় নম্বর বাড়ি, বাঁ দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্রা ভবন’, বলতে নেই নজর না লাগে, সে সব তো তেমনই রইল।

Advertisement

প্রণতি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৪৯
Share:

ছোটবেলা: অবনীন্দ্রনাথের তুলিতে নাতি অমিতেন্দ্রনাথ।

বইটি হাতে নিয়ে চমকে গেলাম, ইতিহাস যে হঠাৎ এমন টাটকা দক্ষিণের বাতাসে ভরিয়ে দেবে মনটাকে, ভাবিনি। যাঁর আত্মকথা তাঁর বয়স ছিয়ানব্বই (জন্ম ৯ অক্টোবর ১৯২২)। জ্বলজ্বলে স্মৃতির বিচারে চল্লিশ পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ। অনুলেখক মিতেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের আন্তরিকতাকে সাধুবাদ জানাই, পরম নিষ্ঠায় যিনি লিপিবদ্ধ করেছেন অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পৌত্র অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি অমিতকথা।

Advertisement

সেই তো অগণিত মনে নিবিড় করে আঁকা আছে, ও দিকে বট তো এ দিকে তেঁতুল। ও দিকে জীবনস্মৃতি তো এ দিকে অবনীন্দ্র-স্মৃতি। দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের সরু গলিটা পেরলেই সামনে ছবির মতো ফুটে ওঠে ছয় নম্বর বাড়ি, বাঁ দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্রা ভবন’, বলতে নেই নজর না লাগে, সে সব তো তেমনই রইল। কার অভিশাপে ভারতের শিল্প-ইতিহাসে শাশ্বত স্থান অধিকার করে থাকা ‘দক্ষিণের বারান্দা’ কোন শূন্যে মিলিয়ে গেল। দ্বারকানাথের বৈঠকখানা বাড়ি, তথা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র গিরীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারীদের বাসগৃহ ‘পাঁচ’ নম্বর বাড়ি, কে ভেঙে ফেলল, কেন? সে ভাঙনের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কান্না কান পাতলে আজও শোনা যায়। কিন্তু এই নবতি নবীনের সত্যকথন নতুন করে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, দেখছি ওই ভাঙন যে অপ্রতিরোধ্য ছিল।

বিকেলবেলা পাঁচ নম্বর বাড়ির বাগানে বাড়ির এক দল ছেলেমেয়ে রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলছে, গাইছে বাল্মীকিপ্রতিভা-র গান ‘‘এনেছি মোরা এনেছি মোরা রাশি রাশি লুটের ভার’’, হঠাৎ ছয় নম্বর বাড়ির উপর থেকে দিনু জ্যাঠামশাই ডাক দিলেন, ‘‘এই ছেলেমেয়ের দল, ওপরে আয়! রবিকা একটা নতুন গান বেঁধেছেন, আয় তোদের শিখিয়ে দিই।’’ দিনেন্দ্রনাথ ওদের শেখালেন তাঁর রবিকার নতুন বাঁধা বর্ষার গান ‘‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো, কর স্নান নবধারাজলে।’’ বাগানে ফিরে নতুন গান গাইতে গাইতে খেলা শুরু করতেই আবার বাধা ও বাড়ি থেকে, দিনেন্দ্রনাথের কাকা অরুণেন্দ্রনাথ বাগানে এসে হাঁটুর ওপর তাল দিতে দিতে, তাঁদের সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের গান শিখিয়ে দিলেন— ‘‘মাকড়টা ফুলবনে খাসা বোনে জাল/ পোকামাকড় লটকে পড়ে/ মাছি পালে পাল।’’ ছোটরা সমস্বরে সে গান যখন গাইছে, দোতলার বারান্দা থেকে দাদামশায় জানালেন, এ গান তাঁর না-পসন্দ। মজা এই আট বছরে শেখা সেই গান আশি বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে স্ব-আবাসের বারান্দায় বসে যখন আপন মনে গাইছিলেন অমিতেন্দ্রনাথ, পথে যেতে যেতে মোহন সিং এসে আবার গানটা শুনতে চাইলেন, আর তখনই বিস্মিত গায়ক জানতে পারলেন, গানটি ‘মারু বেহাগ’ রাগের।

Advertisement

অমিতকথা
অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর
২০০.০০
সিগনেট প্রেস

পিতামহ অবনীন্দ্রনাথকে কেন ‘দাদামশায়’ সম্বোধন, অমিতেন্দ্র জানালেন, শোভনলাল, মোহনলাল ও রেবা তাঁর পিসতুতো দাদাদিদি, এঁদের জন্ম, বড় হওয়া সবই জোড়াসাঁকো বাড়িতে, ‘‘আমি ওঁদের বড়দা-ছোড়দা ও দিদি বলেই জানতুম। তাই ওঁদের মতো আমার পিতামহকে কোনও দিন ঠাকুরদা সম্বোধন করিনি, দাদামশায় বলেই ডেকেছি।’’ পিসেমশাই মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের ঘরজামাই।

এ বইয়ে বেশ একটু স্থান করে নিয়েছেন কবি জসীমউদ্‌দীন। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছেন। মোহনলালের প্রস্তাবে জোড়াসাঁকোর ছ’নম্বর বাড়িতেই তাঁর কিছু কালের বসবাস, মেলামেশা, দেখাশোনা।

রবি অস্তমিত হলে জোড়াসাঁকো বাড়িতে অন্ধকার নেমে এল। বিশেষ করে পাঁচ নম্বর বাড়ির আর্থিক অবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, জমিদারির আয় থেকে বিশাল পরিবারের খরচ অসম্ভব হল। গগনেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে লর্ড রোনাল্ডশে-র অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল, চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে জমিদারিটি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসে নিয়ে নেওয়া হয়, তারা মাসোহারা দেবে এবং ক্রমে ক্রমে ধার শোধ করবে। ‘‘কোর্ট অফ ওয়ার্ডস থেকে বলা হয় যে কলকাতার সম্পত্তি পুরোটা বিক্রি না করলে সম্পূর্ণ ধার শোধ করা যাবে না। তাই ১৯৪১ সালে আমরা জোড়াসাঁকো পাঁচ নম্বর বাড়ির বসবাস ছেড়ে উঠে আসতে বাধ্য হই।’’ গগনেন্দ্র-পরিবার চলে গেলেন ল্যান্সডাউন প্লেসে, সমরেন্দ্রনাথ বালিগঞ্জের সুইনহো স্ট্রিটে। অমিতেন্দ্রনাথের স্মৃতি সেই ভাঙনের ছবিটা বাস্তবে ও কান্নায় মিলিয়ে এমনই সুস্পষ্ট করে তোলে, পাঠকের বুকের মধ্যে সে যে কী পাষাণভার জমিয়ে তোলে, ভাষা নেই যে বর্ণনা করি, ‘‘শুধু আমরাই পড়ে রইলুম দোতলার পশ্চিমের অন্দরমহলে। তখন বাড়ির লোকজন কেউ নেই বললেই চলে। বা’র বাড়িতে আর ঝাড় পোঁছ হয় না, বাড়ির গা থেকে চুন বালির বড় বড় চাঙড় ভেঙে পড়ছে প্রায়ই। ছুটি হয়ে গেছে দারোয়ানদের। একতলার ধুলোয় ভরা বারান্দা সব যেন গিলতে আসছে। বাগানের পাশে দফতর খানা, তোশা খানা সব বন্ধ, অপরিষ্কার। ম্যানেজার, সরকারদের ছুটি হয়ে গেছে, তারা চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। বাগানের গাছঘরের একপাশ ভেঙে পড়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। বাগানে লতার ঝাড়-ছাওয়া পারগোলার লোহার ফ্রেম চুরি হয়ে গেছে।’’

লক্ষ্মী তো অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন এ বার পালা সরস্বতীর। অবনীন্দ্র-পরিবারের নবনীড় রচিত হল বরানগরের ভাড়াবাড়িতে, ‘গুপ্তনিবাস’। ‘‘যে শালগ্রাম শিলা একদিন আদি বাড়ি থেকে নীলমণি ঠাকুর নিয়ে এসেছিলেন, তাকে আর একদিন সকালে ঠাকুর মশায় গলায় ঝুলিয়ে বাবার [অলোকেন্দ্রনাথ] সঙ্গে বরানগরের গুপ্তনিবাসে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠা করলেন।’’ বিরহের স্মৃতিতেই আটকে থাকে না জীবন, সে আবার পাখা মেলে, যে যার মতো করে নিজে সাজে, চারপাশকে সাজায়, জানে, দেখে, শোনে, নদীর মতন বয়ে চলে, ‘‘গুপ্তনিবাসে এসে আমরা জোড়াসাঁকো হারানোর শোক অনেকটাই ভুলতে পেরেছিলুম। সুন্দর বড় সাজানো বাগান, তিনখানা বড় বড় পুকুর ছিল— কলকাতার মধ্যে থাকলে তো এসব পাওয়া যেত না।’’ কিছু দিন যেতে না যেতে বড়দা মোহনলালকে ডেকে নিলেন দাদামশায়। অমিতেন্দ্রনাথের স্মৃতিতে বড়দা মোহনলাল বড় উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছেন, মেধাবী, গুণী, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটির ছেলেবেলা থেকেই তাঁর অন্তরে স্থায়ী আসন।

অমন যে গুপ্তনিবাস সেখানেও তেমন থাকা হল কই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমার আতঙ্কে সপরিবারে শান্তিনিকেতনে। অমিতেন্দ্রনাথের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ছাত্রদের সঙ্গে খেলতে চেয়েছিলেন, সেই আগ্রহটুকু তাঁকে পৌঁছে দিল চিনা ভবনের দরজায়, সেখানে ছাত্রের অপেক্ষায় তান সাহেব। তান সাহেবের ব্যক্তিজীবনের অনেকটা ইতিহাস এবং তাঁর অপরিমিত আত্মত্যাগের কথা সহজ বিস্তারে ধরা পড়েছে। কী সব মানুষ এঁরা! অমিতকথা-য় তার অমিতমূল্য গাঁথা হয়ে রইল।

স্মৃতিকথার মোড় এ বার ঘুরে গেল, পাঁচ বছরের পাঠক্রম শেষ করে চিনযাত্রা। চিনা ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর জ্ঞানার্জন শেষে প্রত্যাবর্তন। চিনা ভবনের প্রাক্তন ছাত্র এ বার শিক্ষক। চিনা ভাষার বিশেষজ্ঞ হিসাবে দেশেবিদেশে কত কত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ডাক পড়ল, অধ্যাপনা করলেন, সম্মান পেলেন। সম্মানিত অধ্যাপক হিসাবে দুই মহাদেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের বিশিষ্ট সময় কাটিয়েছেন। তবে, ‘‘শান্তিনিকেতনের মতো ভাল আর কোথায় লাগেনি।’’

আসন্ন শতবর্ষী অমিতেন্দ্রনাথের অস্তিত্বের সঙ্গে আজও তো জড়িয়ে আছে জোড়াসাঁকো বাড়ি, দাদামশায়, চিনা ভবন, তান সাহেব, শান্তিনিকেতন— প্রায় একটা গোটা বিশ্ব।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর মধ্যে এ কোন শীতল স্পর্শ ও সম্পূর্ণতার পরিচয় রেখে গেল প্রবীণের এই নবীন গ্রন্থ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন