Book Review

প্রকৃত লড়াইয়ের পথ খোঁজা

ভূমিকা-সহ ষোলোটি ছোট ছোট অধ্যায়ে লেখক— সিপিআই(এম) দলের সদস্য— দেবেশ দাস তথ্যের সরকারি ও অন্যান্য সূত্র ঘেঁটে বার করেছেন আমাদের দেশে দলিত-জনজাতিদের নানাবিধ বঞ্চনার কথা।

Advertisement

সনৎ দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ০৯:০৫
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

“বামপন্থী ভাবনায় এটা আছে যে মেহনতি মানুষের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একদিন জাতপাত উঠে যাবে।” উক্তিটি কার, সঙ্কেত ছাড়াও সহজেই এ প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়া যায়: এটি নিশ্চিত কোনও বামপন্থী দলের নেতা বা কর্মীর। ‘লড়াই সংগ্রাম’, শব্দযুগলই সঙ্কেত, যার উপর স্ব-ঘোষিত বাম দলের স্বত্বাধিকার পাকা, কিন্তু বাংলা ভাষার বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে তা চলল না। না চলার কারণ অনেকটাই পাওয়া যায় বক্তার পরবর্তী কয়েকটি বাক্যে: “শাসকশ্রেণিই যেহেতু কৃষি বিপ্লবেরও বিরুদ্ধে ও আজ জাতপাতেরও মদতদাতা, তাই কৃষি বিপ্লব মানে জাতপাতের বিরুদ্ধেও লড়াই।... কৃষি বিপ্লব করতে গেলে মেহনতী মানুষের যে লড়াই হবে, তাতেই কি জাতপাত উঠে যাবে?” বাস্তব পরিস্থিতির শ্রমসাধ্য অনুধাবন থেকে উঠে আসা এই সন্দেহের ভিতর দিয়ে, লেখক তাঁর দলেরএত দিন ধরে গৃহীত অবস্থানকে প্রশ্ন করছেন: একমাত্র শ্রেণির লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই জাতপাতের মতো দীর্ঘলালিত উৎপীড়ন ও শোষণের হাতিয়ারকে চূর্ণ করা যাবে, এই আপ্তবাক্য থেকে বেরিয়ে নতুন পথের সন্ধান করছেন। তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং তা থেকে গড়ে ওঠা জিজ্ঞাসু মনন তাঁকে শিখিয়েছে, “জাতপাতের বিরুদ্ধে... লড়াই বাইরে, লড়াই ভিতরে, লড়াই মনের গভীরে।”

Advertisement

ভূমিকা-সহ ষোলোটি ছোট ছোট অধ্যায়ে লেখক— সিপিআই(এম) দলের সদস্য— দেবেশ দাস তথ্যের সরকারি ও অন্যান্য সূত্র ঘেঁটে বার করেছেন আমাদের দেশে দলিত-জনজাতিদের নানাবিধ বঞ্চনার কথা। যাঁদের শ্রমে গড়ে উঠেছে এই দেশের বিপুল সম্পদ, সেই মানুষরা সেই সম্পদের কণামাত্র ভাগও পান না। আর, তাঁরা যাতে তা না পান, তার জন্য শাসকবর্গ অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে এই মানুষদের দূরে রাখে আইনসভা, বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, মিডিয়া ও অন্য প্রভাবশালী পদগুলি থেকে। কেবল দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বর্ণন যে যথেষ্ট নয়, এই বঞ্চনাগুলোকে যে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াটা যে একটা রাজনৈতিক কাজ, দেবেশ সেটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের বক্তব্যকে তিনি প্রামাণ্য তথ্যের মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন।

ভারতের শাসনকাঠামোয় জাতপাত

Advertisement

দেবেশ দাস

১২০.০০

পথ সংকেত

পাশাপাশি তিনি অনুসন্ধান করেছেন জাতপাতের উৎস ও তার পরম্পরা, এবং জাতপাতের সঙ্গে দেশের উৎপাদন সম্পর্কের জটিল সংমিশ্রণ ও সমীকরণের দিকটা নিয়ে। অনুসন্ধানের পথটি তিনি পেয়েছেন মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে, যা তাঁকে দিয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের পদ্ধতি। এই বিশ্লেষণে তিনি জাতপাতজনিত উৎপীড়নকে কেবল একটি বিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখছেন না, সমগ্র সমাজকাঠামোর অংশ হিসাবে দেখছেন। এই কাঠামোতে কেবল নিচু জাতি বা জনজাতিরাই জন্মসূত্রে বঞ্চিত, উৎপীড়িত নন— দেশের নারী জনগোষ্ঠী, জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে যাঁদের অর্ধেক আকাশ হয়ে ওঠার কথা, তাঁরাও কেবল তাঁদের জৈবিক গঠনের সূত্রে জন্মজাত ভাবে ঘোর অবমাননা ও অত্যাচারের শিকার। জাতপাত থেকে মুক্তির লড়াই তাই অন্যান্য পরিচিতিগত এবং শ্রেণিগত লড়াইগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে লড়তে হবে, যা ব্যতিরেকে দেশের সামগ্রিক মঙ্গলের দিকে এগোনো অসম্ভব।

বামপন্থী প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা তাঁকে ‘লড়াই-সংগ্রাম’এর মতো কৃত্রিম শব্দ ব্যবহারে প্রাণিত করে, ঠিকই, কিন্তু তাঁর আন্তরিক বামপন্থী অনুশীলনই আবার কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত লড়াইয়ের পথ খুঁজতেও সহায়তা দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন