Book Review

ক্ষণিকেই সার্থকতা, তাতেই নিহিত বিস্মরণের বীজ

আবার সেই কারণেই সেটা জরুরি। পেশায় তিনি ছিলেন বেতার সাংবাদিক। সাধারণ ভাবে সাংবাদিকতার ধর্ম ও সঙ্কটও কিন্তু এই তাৎক্ষণিকতা।

Advertisement

সুপ্রিয় রায়

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:২৪
Share:

সম্পাদক ভবেশ দাশ দীর্ঘ দিন ধরেই বাঙালি জীবনের কয়েকটি অত্যুচ্চ অভিজ্ঞানের লুপ্তপ্রায় চিহ্নকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের হাতে সমর্পণ ও সংরক্ষণের কাজ করে চলেছেন। তাঁর বিশেষ অভিনিবেশের বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম দু’টি— এক, তাঁর একদা কর্মস্থল আকাশবাণী; এবং দুই, বাংলা নাট্যজগৎ। এ দুইয়ের মধ্যে এক লক্ষণীয় মিল হল এই যে, দু’টিরই মূল ধর্ম এক— তাৎক্ষণিক মুহূর্ত নির্মাণে তার সার্থকতা আর সেখানেই তার সঙ্কট। এই কারণেই তার ইতিহাস সংরক্ষণ কঠিন। আবার সেই কারণেই সেটা জরুরি। পেশায় তিনি ছিলেন বেতার সাংবাদিক। সাধারণ ভাবে সাংবাদিকতার ধর্ম ও সঙ্কটও কিন্তু এই তাৎক্ষণিকতা। বহমান মুহূর্তগুলি, বিচ্ছিন্ন বা সংযুক্ত, তার দর্পণে পাঠকের মনে এমন এক অভিজ্ঞতার জন্ম দেওয়া, যা তার দৈনন্দিনের মধ্যে, আবার বাইরেও। সে দিক থেকে দেখলে, ভবেশ দাশের কাজগুলি বাঙালির প্রতিভাবান কিন্তু পরিশ্রমবিমুখ, ক্ষণপিপাসু আত্মবিস্মরণের বিপুল স্রোতের বিপরীতে এক অহিংস প্রতিরোধ।

Advertisement

আলোচ্য তন্বী গ্রন্থটি তাঁর সর্বোচ্চ আগ্রহের বিষয় আকাশবাণী প্রসঙ্গে। এই এক আশ্চর্য পরীক্ষাগার, বাঙালি মনীষার এক বিপুল বিকাশ, বিগত একশো বছরের অগণন ভাঙা-গড়ার এক সরব সাক্ষী— বাণীকুমারের বর্ণনায় ‘হাওয়ায় তাজমহল’ গড়েই সে খালাস, আত্মঘোষণায় অমনোযোগী, আত্মসংরক্ষণে অবিশ্বাসী, অথচ আজও, বাংলা কৃষ্টির এক অতন্দ্র প্রহরী, এক সর্বজনমান্য অনতিক্রম্য মাপকাঠি।

কলকাতা বেতার: দশ ব্যক্তিত্ব

Advertisement

ভবেশ দাশ

৪২৫.০০

সাহিত্য সংসদ’

এই প্রতিষ্ঠানের সরকারি দস্তাবেজ (পরবর্তী কালের মধ্যমেধার চোখে যাকে হয়তো কখনও কখনও মনে হতে পারে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়), নথি ও পুঁথিপত্র, বিশেষ করে বিলুপ্ত বেতার জগৎ-এর প্রায়-লুপ্ত সংখ্যাগুলির নিরন্তর সন্ধান ও বেতার-স্পৃষ্ট বিদগ্ধদের স্মৃতিকথায় নির্ভর করে, একের পর এক গ্রন্থে ভবেশ দাশ পুনরুদ্ধার করে চলেছেন এক হারানো সভ্যতার, এক জীবনে, এককের পক্ষে যতটা সম্ভব। আলোচ্য, কলকাতা বেতার: দশ ব্যক্তিত্ব তার সাম্প্রতিকতম।

স্বভাবে সম্পাদক ভবেশ দাশ লেখেন কম। আবার সেই লেখার মধ্যেও সন্তর্পণে সংগোপন থাকেন নিজে। বাঙালি, বিশেষত বেতারগর্বী বাক্‌পটু ও সিদ্ধ শিল্পীদের মধ্যে এই গুণ বিরল। বেতারে সংবাদ ও সংবাদ-সংশ্লিষ্ট নানা গদ্য, যেমন ‘সমীক্ষা’, রচনার অভিজ্ঞতা তাঁর গদ্যকে দিয়েছে এক সহজ-গভীর চলন যার মধ্যে হাওয়া চলে, যেখানে লেখক থাকেন আড়ালে। হাতেগোনা সুনির্বাচিত শব্দসংখ্যার পরিধির মধ্যে যা অনেকখানি ভাবপ্রকাশে সক্ষম, এবং শ্রবণবোধ্য, যার সর্বাঙ্গে বিবেচনার গন্ধ লেগে থাকে। বস্তুত, গবেষকের মধ্যে এই গুণই সবচেয়ে জরুরি, বিষয়ে অঙ্গাঙ্গি থেকেও জড়িয়ে না পড়া, যে চারিত্র এই প্রকাশনাতেও লক্ষণীয়। দুর্বলতার নিদর্শন তল্লাশ করা যদি সমালোচকের দায় হয়, তা হলে বলার, কিছু মুদ্রণপ্রমাদ দৃষ্টি এড়িয়েছে, যা কিঞ্চিৎ অপ্রত্যাশিত, অন্তত তাঁর মানে। বাকিটুকু অতৃপ্ত তৃষ্ণা, এ রকম আরও কিছু বেতারধন্য ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের পদস্পর্শের কাহিনি কি তিনি এড়ালেন, কলেবরবৃদ্ধি এড়াতে? আকাশবাণীর সময়-নিগড় পুস্তকে যে-হেতু নেই, আরও খানিকটা পেলে ক্ষতি কী ছিল? একটি সংযোজনের লোভ এড়াতে পারছি না। এক, ৩৬ পৃষ্ঠায় দেয়া ২ নম্বর টীকায় দীনা গান্ধীর (পরবর্তী কালে, পাঠক) পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক তাঁর দুই গুণী কন্যা, সুপ্রিয়া পাঠক ও রত্না পাঠকের নাম উল্লেখ করেছেন। এক জামাতারও নাম উল্লেখ আছে, নাসিরুদ্দিন শাহ। অন্য জামাতাটিও কিন্তু তা হলে অনুল্লেখ্য নন। তিনি পঙ্কজ কপূর, অভিনেতা হিসাবে খাটো নন।

একটি আপত্তিও নথিভুক্ত থাকুক। ৮৪ পৃষ্ঠায় বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃত মন্তব্য: “একেবারে গলাবন্ধ বক্তৃতা, নয় দাদুমণি কি পঙ্কজ মল্লিকের গা-খোলা গা-ঘেঁষা অন্তরঙ্গতা— এ দুয়ের মাঝামাঝি যে সরস ও সংযত বলবার ধরণ, যাতে শিক্ষিত লোক বন্ধুদের মজলিসে কথা বলে, যে ধরণ কমই শোনা যায়।” এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেখক বলেছেন, “ইদানীং এফ এম রেডিও চ্যানেলগুলির উপস্থাপকদের বাচনকলা নিয়ে তিনি কী অভিমত ব্যক্ত করতেন?” লেখক যে অভিমত অনুমান করেই নিয়েছেন, তার বিপরীতটাই বরং এই প্রতিবেদকের বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। বিগত পঁচিশ বছরে আকাশবাণী এফএম যে অন্তরঙ্গ অথচ সুভদ্র বাংলা বলেছে, কে বলতে পারে, হয়তো বুদ্ধদেব সেই কথ্য ভাষারই অপেক্ষায় ছিলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন