পুস্তক পরিচয় ২

ধূসর সময়ের বয়ান

সিস্টার নিবেদিতার জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এই উপলক্ষে বেশ কিছু গ্রন্থ-প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, আরও প্রকাশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০১:০৮
Share:

রামানন্দ নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথ/ জাতীয়তাবাদ ও গোরা-বিতর্ক

Advertisement

অর্ণব নাগ

২৭৫.০০, গাঙচিল

Advertisement

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বঙ্গদেশে সিস্টার নিবেদিতা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কর্মের যে উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গিয়েছেন তা সর্বকালের শ্রদ্ধা ও বিস্ময় উদ্রেক করে। সিস্টার নিবেদিতার জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এই উপলক্ষে বেশ কিছু গ্রন্থ-প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, আরও প্রকাশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আলোচ্য বইটি তেমনই একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ‘প্রবাসী’ ও ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় দেশকে সর্বার্থে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে ছিলেন কৃতসংকল্প। সিস্টার নিবেদিতাও একই পথের পথিক। সম্পাদকের আহ্বানে সিস্টার নিবেদিতা এই পত্রিকায় কলম ধরেছেন, এবং তাঁর লেখকসত্তাও নিজস্ব তাগিদে সাড়া দিয়েছে। বিস্ময়ের কথা, এই বিদেশিনি তাঁর বহু ব্যস্ততার মধ্যেও গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে ভারতীয় শিল্পের স্বরূপ অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন। প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে তাঁর অসামান্য শিল্পবোধের প্রকাশ। ১৯১০ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত মুখ্য সম্পাদকের অসুস্থতার কারণে সিস্টার নিবেদিতা ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’-এর সম্পাদকীয় রচনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে প্রসঙ্গ লেখক প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই গ্রন্থে, তেমনই সম্পাদক রামানন্দকে এই তেজস্বিনী তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘এনশিয়েন্ট অ্যাবে অব অজন্তা’ সিরিজ়ের অন্তর্গত ভারতীয় শিল্পে গ্রিক প্রভাবের তত্ত্ব বিষয়ক লেখাটিতে লেটারপ্রেসে সংশ্লিষ্ট অলঙ্করণগুলির ‘‘নির্বোধের মতো স্থান পরিবর্তন’’-এর ত্রুটি নিয়ে চিঠিতে যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সেটির অংশ লেখক উদ্ধৃত করেছেন। রামানন্দ এবং তাঁর পত্রিকা সম্পর্কে সিস্টার উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, অনেক সময়েই তাঁর আলাপ আলোচনায় সে মুগ্ধতা স্থান পেত। অর্ণব নাগ অনুসন্ধানী বিভিন্ন সূত্র থেকে এই জাতীয় নানা তথ্য হাজির করেছেন। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘পুণ্যচরিত কথা’-য় সিস্টার নিবেদিতা প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, সে কথাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। পরিশিষ্টে সন্নিবেশিত প্রসঙ্গকথা-সহ চারটি লেখা, ‘নিবেদিতার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়’, ‘রামানন্দের নিবেদিতা মূল্যায়ন’, ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রামানন্দ-নিবেদিতা’ এবং ‘নিবেদিতার গ্রন্থ-সমালোচক রামানন্দ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বইটিতে সবচেয়ে দীর্ঘ যে রচনাটি পাওয়া গেল সেটি ‘রামানন্দ নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ: গোরা-র নেপথ্যচারণা’। যে কোনও রবীন্দ্রপাঠকই বলবেন এ প্রসঙ্গ সুপরিচিত। লেখাটি পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট; ‘‘দেশের ‘মিউটিনি’-র সময় তাঁকে কুড়িয়ে পেয়ে এক হিন্দু দম্পতি তাঁকে মানুষ করে’’, ‘কুড়িয়ে পেয়ে’ (পৃ ৬৮) কথাটা কেমন হল? প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ‘গোরা’ প্রকাশিত (ধারাবাহিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ভাদ্র ১৩১৪ থেকে ফাল্গুন ১৩১৬ সংখ্যা; গ্রন্থাকারে দুই খণ্ডে ১৯ মাঘ ১৩১৬ বঙ্গাব্দ) হওয়ার পর থেকেই এই উপন্যাস প্রসঙ্গে বিবিধ আলোচনা শুরু হয় সে কথা স্মরণীয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই উপন্যাস প্রসঙ্গে বহু বার সরব হয়েছেন, ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘‘গোরা উপন্যাসে কী বস্তু আছে না-আছে উক্ত উপন্যাসের লেখক তা সব চেয়ে কম বোঝে। লোকমুখে শুনেছি প্রচলিত হিঁদুয়ানির ভালো ব্যাখ্যা তার মধ্যে পাওয়া যায়। এর থেকে আন্দাজ করছি ওটাই বাস্তবতার লক্ষণ।’’

ঘটিপুরুষ

বিশ্বজিৎ রায়

১৫০.০০, দে’জ পাবলিশিং

বেশ কয়েক বছর পর নতুন সংস্করণ হল ঘটিপুরুষ-এর। এর মধ্যেই পাঠকের হাতে পৌঁছে গিয়েছে বিশ্বজিৎ রায়ের লেখা পরবর্তী স্মৃতি-আখ্যানগুলো। তবু, ঘটিপুরুষ-এর স্বাদ অক্ষুণ্ণ। এই সংস্করণে যুক্ত হয়েছে বইটি সম্বন্ধে দুটি অতি জরুরি মূল্যায়ন।

বইটিকে অনেক ভাবে প়ড়া যায়। টুকরো টুকরো আখ্যান, আপাত তাৎপর্যহীন কথা দিয়ে শুধু এক নিম্নমধ্যবিত্ত গৃহস্থালি নয়, একটা গোটা সময়কে ধরা হয়েছে যা এক বালকের চোখে দেখা, বইটির এই পাঠ সম্ভব। অথবা, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে বাজার ব্যবস্থায় পর্বান্তরের ধূসর সময়ের বয়ান হিসেবেও দেখা যায় বইটিকে।

আর একটি পাঠও সম্ভব— এক জন পরাজিত মানুষের আখ্যান। বিশ্বজিৎ তাঁর বাবার গল্প বুনেছেন খুচরো আখ্যানে। স্বল্প বেতনের ছেঁড়া কাঁথায় সংসার ঢাকার গল্প, মাসের শেষে ভোঁতা ব্লেডে দাড়ি কামানোর গল্প। সেই বাবার কথা, একদা যাঁর ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাতি ছিল গ্রামে, কিন্তু সন্তানরা জানতেই পারেনি বাবার সেই বিশিষ্টতার কথা। দৈনন্দিনতার হেরে যাওয়ার ফাঁকে সেই কথা হারিয়ে গিয়েছিল। এবং এই বই সম্বন্ধ করে হওয়া বিয়ের বউয়ের চোখে কখনও উপযুক্ত স্বামী হয়ে না উঠতে পারার অনতিক্রম্য ব্যর্থতার গল্প। সেই মানুষটির কথা, যাঁর ছেলে ভাবত, এক দিন ঠিক বাবা বাজার থেকে না ঠকে বাড়ি ফিরবে। হয়তো তিনি নিজেও ভাবতেন, দুই ছেলের পাতে দুটো গোটা আম দেওয়ার পরও তাঁরা স্বামী-স্ত্রীও পাবেন গোটা হিমসাগরের স্বাদ। এই গদ্য ব্যক্তিগত। আবার, প্রবল ভাবে সমষ্টিরও। অনেকের স্মৃতিতেই হয়তো আছে এমন কোনও পরাজিত পুরুষের আখ্যান। আবেগের স্রোত না বইয়েও এমন একটি লেখা লিখতে পেরেছেন, বিশ্বজিতের সেই কৃতিত্ব বড় কম নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন