Book Review

মুসলমান সমাজের বহুস্বর

বইটি পাঁচ পর্বে সাজানো। ভাষা-সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, ব্যক্তিত্ব, পত্রপত্রিকা, বিবিধ প্রসঙ্গ। গোপাল হালদারের ‘মুসলমান বাঙালীর কালচার’ প্রবন্ধ দিয়ে প্রথম পর্ব শুরু।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:২৩
Share:

দিশারি: (বাঁ দিক থেকে) কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ এবং সৈয়দ আমির আলী।

১৯৪৭-এ পূর্ব পাকিস্তান, আর তার পরে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির পর থেকে পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানের রাজনীতি, সৃষ্টিকর্মের উপর আলোকপাত হলেও তার আগে উনিশ-বিশ শতকে কলকাতা (এবং ঢাকা)-কেন্দ্রিক বাংলাভাষী মুসলমানের যাপন ও সামাজিক অভিপ্রায়গুলি অনেক কম জানা। সাধারণ পাঠকের ঠিক আন্দাজ নেই কোন ধরনের সূত্র থেকে এই বিপুল সময়ের বিস্তৃত ও ঋদ্ধ ইতিহাসজানা যেতে পারে। এ জন্য আলোচ্য বইটি জরুরি।

বইটি পাঁচ পর্বে সাজানো। ভাষা-সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতি, ভাষা ও সাহিত্য, ব্যক্তিত্ব, পত্রপত্রিকা, বিবিধ প্রসঙ্গ। গোপাল হালদারের ‘মুসলমান বাঙালীর কালচার’ প্রবন্ধ দিয়ে প্রথম পর্ব শুরু। বাংলার সুলতানদের দরবারে যে মার্গীয় বাংলা সাহিত্যের লালন ও বিকাশ, এ কথা দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন। কিন্তু মধ্যযুগের মুসলমান কবিমাত্রেই যে দরবারি নন, সে কথা জানতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। গোপাল হালদারের কাছে ‘দরবারী’ দৌলত কাজীর সঙ্গে দরবারের বাইরে থাকা সৈয়দ সুলতান, মোহাম্মদ খানও দরবারি কবি। সৈয়দ সুলতান ইসলামের নবি-কাহিনী নবীবংশ, মহম্মদের জীবনালেখ্য রসুল বিজয় আর মোহাম্মদ খান কারবালার কাহিনি মক্তুল হোসেন লিখলেও যখন বাংলা সাহিত্যের অগ্রণী গবেষক গোপাল হালদার এঁদের সম্পর্কে বলেন যে, “তাঁদের কল্পনা ফার্সি জিন-পরীদেরও ক্রমে ক্রমে এ দেশের দেবদেবীর মত স্বচ্ছন্দ করে তুলল”— তখন সহজেই অনুমেয় যে, যে ইতিহাসচেতনা আমাদের উত্তরাধিকার তা কতটা ‘আন-লার্ন’ করলে তবে বঙ্গের মুসলমান সম্পর্কে একটা সম্যক ছবি পাওয়া সম্ভব।

ভারতীয় মুসলমানরা এ দেশের শিক্ষা-সভ্যতা ও অতীতকে শ্রদ্ধা করেন না, এই দেশকে স্বদেশ মনে করেন না— হিন্দু জাতীয়তাবাদের এই কেন্দ্রীয় ভাবনাটি এমনই ‘হেজিমনিক’ যে, মুসলমান সমাজের এক অংশের লেখকরাও অনেকে এই সময়কে বাংলায় মুসলমানের আত্মতা নির্মাণকে বাঙালি বনাম মুসলমান এই সমীকরণেই পড়েছেন। একে ‘মুসলমান সম্প্রদায় কর্তৃক নিজেদের বাঙালীরূপে পরিচয় প্রদানে অনীহা’ বলে দেখেছেন এই সঙ্কলনের এক প্রাবন্ধিক রশিদ আল ফারুকী (১৯৪০-১৯৮৭)। এই পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে মুসলমানের কট্টর ইসলামি ‘মিয়াঁ কালচার’-এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন, এব‌ং খানিকটা যেন ন্যায্যতাই দিয়েছেন।

সমাজ-রাজনীতি-ভাষা নির্বাচনের সমস্যা ও তা সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে দেয়, এই সময়ের বাঙালি মুসলমানের ভাবনা কতখানি মৌলিক ও তার্কিক ছিল। রাজনীতিতে স্বাতন্ত্র্য-নীতিকে দুর্বলের নীতি বলে আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮) তাঁর ‘আমাদের রাজনীতি’ প্রবন্ধে ‘মুসলিম সেপারেট ইলেক্টরেট’-এর বিরোধিতা করছেন। তিনি চান, ‘সৃষ্টি-লোলুপ’ মুসলমানরা খোলা প্রাঙ্গণে হিন্দুর সঙ্গে খোলা প্রতিযোগিতায় সমদক্ষ হয়ে উঠুক। মৃণালকান্তি দাশের ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যায় যুক্ত চেষ্টা ও মুসলিম সাংবাদিক’ প্রবন্ধে সাংবাদিক ও মোহাম্মদী পত্রিকা সম্পাদক যে মৌলানা আকরম খাঁয়ের (১৮৬৮-১৯৬৮) অকুণ্ঠ প্রশংসা, সেই আকরম খাঁকেই ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুসলমান’ প্রবন্ধে তীব্র ভাষায় নিন্দা করছেন রেজাউল করিম (১৯০২-১৯৯৩)। মোহাম্মদী পত্রিকাকে তিনি মোল্লাদের আখড়া বলে আক্রমণ করছেন। এই পরস্পরবিরোধী ভাষ্যগুলি থেকে, সমাজের নানা অবস্থান থেকে আসা নানা যুক্তিতর্ক থেকে একটা সমাজের নানা স্বরকে বুঝে নেওয়ার থাকে। দেখা যায়, বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের এক অংশের সাম্প্রদায়িক সমন্বয়ের প্রস্তাবে কেমন ভাবে নিহিত ছিল হিন্দু হেজিমনি। হিন্দুপ্রধান জনপরিসরে কী ভাবে এই নরমপন্থী মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আপস করারই ছিল। মোহাম্মদী পত্রিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচি মুসলমান বিদ্বেষ-পরিপূর্ণ বললে, রেজাউল করিম তা প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে খণ্ডন তো করেনই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক পদ্মটিতে হিন্দু সাকার উপাসনার ছায়া— মোহাম্মদী-র এই অভিযোগও তিনি উড়িয়ে দেন।

বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা নিয়ে বিতর্ক, মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে দাবি করা, এই সময়ের অন্যতম সূচক। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সদস্য, ‘কলমি পুঁথি’র সংগ্রাহক আবদুল গফুর সিদ্দিকী (১৮৭২-১৯৫৯) তাঁর প্রখ্যাত ‘বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা’ প্রবন্ধে বাংলাভাষী মুসলমানের উপর কলকাতা-কেন্দ্রিক উর্দু আগ্রাসনের পদ্ধতিগুলি আলোচনা করে, মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে সওয়াল করেন। বহুভাষাভাষী দেশে কোনও একটি ভাষাকে (এ ক্ষেত্রে উর্দু) সবার উপর না চাপিয়ে অঞ্চলভিত্তিক ভাষার বহুত্ব রক্ষা করার যে দাবি তাঁর প্রবন্ধে উঠে আসে, তা মুসলিম সাহিত্য সমাজের অষ্টম বর্ষীয় অধিবেশনের অভিভাষণে বলেছেন এই সঙ্কলনের আর এক প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ-ও (১৮৯৮-১৯৭৪)।

ঔপনিবেশিক বাংলায় মুসলমান: ভাষা-সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতি-ব্যক্তিত্ব (১৯০০-১৯৪৭)

সঙ্কলন ও সম্পা: সৌম্য বসু

৭৫০.০০

তবুও প্রয়াস

বর্গের দিক থেকে এই সঙ্কলনগ্রন্থগুলিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াকিল আহমেদের উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা-র (বাংলা অ্যাকাডেমি ১৯৮৩) পাশে রেখে দেখা যেতে পারে। বাঙালি মুসলমানের সমাজচেতনার আখ্যান রচনার জন্য ওয়াকিল আহমেদ বাংলার ফারসি ও উর্দুভাষী মুসলমানদের কর্মপরিধির একটি পটভূমিও তৈরি করেন, যেখানে বিশেষত সৈয়দ আমির আলী ও নবাব আবদুল লতিফের সমাজচিন্তা ও সংস্কারমূলক প্রচেষ্টা আলোচিত। প্রসঙ্গত, রফিউদ্দিন আহমেদের আজ অবধি অপ্রতিদ্বন্দ্বী আকর গবেষণাগ্রন্থ দ্য বেঙ্গল মুসলিমস ১৮৭১-১৯০৬: কোয়েস্ট ফর আইডেন্টিটি (১৯৮১) সমসময়ে প্রায় সমান্তরাল ভাবে প্রকাশ পায়। এ বার পথিকৃৎ এই বই দু’টি প্রকাশ পাওয়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে বাঙালি মুসলমানের ভাষা সাহিত্য সমাজ আত্মপরিচয় নিয়ে সঙ্কলনগ্রন্থগুলির দিকে ফিরলে দেখা যাবে, বাঙালি মুসলমানের চেতনা বোঝার জন্য এখনও এই বই দু’টিকে কার্যকর সূত্র বা দিশা হিসেবে দেখা হয়ে উঠছে না।

গ্রন্থপ্রসঙ্গে সম্পাদকের ভূমিকায় যখন বলা হয় যে “লেখক পরিচিতি ইচ্ছা সত্ত্বেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ বহু লেখকের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়নি”— একটু অবাকই হতে হয়। এই বিষয়ের গবেষকদের কাছে সঙ্কলনভুক্ত অধিকাংশ নামই পরিচিত। ফলে তাঁদের নানা গ্রন্থে-প্রবন্ধে এই লেখকদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তাঁরা কেউ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, কেউ সুধাকর, কেউ মুসলিম সাহিত্য সমাজের শিখা বা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্পাদিত অন্য পত্রিকার নিয়মিত লেখক। আর যে ব্যক্তিত্বদের নিয়ে পরের দিকের লেখকরা ‘ব্যক্তিত্ব’ পর্বে লিখেছেন, যেমন, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজী আবদুল ওদুদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী বা মৌলানা আকরম খাঁ— এঁদের পরিচয় জানার জন্য তো হাতড়াতেও হয় না। এমনকি গুগল করলে গবেষণাগ্রন্থে তো বটেই, বাংলাপিডিয়া-র মতো জনমাধ্যমেই অজস্র তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়াও যে সঙ্কলন থেকে সম্পাদক এই প্রবন্ধগুলি আহরণ করেছেন, সেগুলির সম্পাদকেরাও হয়তো তাঁদের প্রাথমিক সূত্রের খবর দিতে পারতেন। সম্পাদকের নিজেরই যদি তাঁর নির্বাচিত লেখকদের পরিচয় না জানা থাকে, তা হলে সঙ্কলনে লেখক বা প্রবন্ধ নির্বাচনের কোনও বিশেষ যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

অধিকাংশ প্রবন্ধই অন্য কোনও পুনর্মুদ্রিত সঙ্কলন থেকে তুলে আনা। কিন্তু প্রবন্ধের শেষে শুধু অন্য সঙ্কলনের নাম ও সেই সঙ্কলনের ছাপা হওয়ার তারিখ; কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা-ও নেই। কবে কোথায় মূল লেখাগুলি ছাপা হয়েছিল তার হদিস না থাকায় পাঠকের পক্ষে এই পুনর্মুদ্রিত সারণি থেকে কোনও একটা সময়ের কাঠামো বোঝা সম্ভব হয় না। যে বাঙালি মুসলমানের সমাজ-পরিসর নিয়ে সাধারণ পাঠকসমাজে এত কম ধারণা, সেখানে সঙ্কলনগ্রন্থগুলির সম্পাদকদের কিছু গবেষণামূলক দায়িত্ব থেকেই যায়, এটা এই বর্গের থেকে আশা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন