চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

অস্তিত্বের বিপন্নতা গ্রাস করে ক্ষমতার আগ্রাসন

‘সিমা অ্যাওয়ার্ড শো’ দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ।আধুনিক ও আধুনিকোত্তর দৃশ্যকলাকে কয়েকটি প্রবণতায় ভাগ করে নেওয়া যায়। ব্রিটিশ শিল্প-তাত্ত্বিক ভিক্টর বার্জিন সেরকম একটা চেষ্টা করেছিলেন। বিভাজনগুলি হল: আর্ট অ্যাজ রিপ্রেজেন্টেশন, আর্ট অ্যাজ ফর্ম, আর্ট অ্যাজ এক্সপ্রেশন ও আর্ট অ্যাজ কনসেপ্ট। পোস্ট-মডার্ন যুগে পৌঁছে ভাবনাই হয়ে উঠেছে শিল্পের প্রধান নিয়ামক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

আধুনিক ও আধুনিকোত্তর দৃশ্যকলাকে কয়েকটি প্রবণতায় ভাগ করে নেওয়া যায়। ব্রিটিশ শিল্প-তাত্ত্বিক ভিক্টর বার্জিন সেরকম একটা চেষ্টা করেছিলেন। বিভাজনগুলি হল: আর্ট অ্যাজ রিপ্রেজেন্টেশন, আর্ট অ্যাজ ফর্ম, আর্ট অ্যাজ এক্সপ্রেশন ও আর্ট অ্যাজ কনসেপ্ট। পোস্ট-মডার্ন যুগে পৌঁছে ভাবনাই হয়ে উঠেছে শিল্পের প্রধান নিয়ামক। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক দৃশ্যকলায়, বিশেষত তরুণ শিল্পীদের কাজে এই চারটি প্রবণতাই রয়েছে। কিন্তু বেশি গুরুত্ব পায় ভাবনা-ভিত্তিক রচনা। এর মধ্য দিয়ে গভীরতর প্রতিবাদী চেতনাকেই উন্মোচিত করতে চান শিল্পী। আজকের ভোগবাদী জীবন প্রবাহে ক্ষমতার আগ্রাসনে অস্তিত্বের যে বিপন্নতা তাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করতে চান আজকের শিল্পী। সেটা তাঁরা করেন গতানুগতিক রূপায়ণ-পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ভাবনার অসামাণ্য স্বাতন্ত্র্যের মধ্য দিয়ে।

Advertisement

‘সিমা অ্যাওয়ার্ড শো’ চলছে কলকাতার চারটি গ্যালারি জুড়ে। সিমার-উদ্যোগে সারা ভারতের ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী শিল্পীর নির্বাচিত দৃশ্যকলার প্রদর্শনীর সূচনা হল এ বার। ২০১৪-র এই অ্যাওয়ার্ড শো-তে কাজ পাঠিয়েছিলেন ২০০০ শিল্পী। তা থেকে প্রদর্শনীর জন্য মনেনীত হয়েছে ১৫৯টি কাজ। পুরস্কৃত হয়েছেন ১২ জন। শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বা সিমা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মনসুর আলি মাকরানি। সিমা ছাড়াও প্রদর্শনী বিস্তৃত ছিল রামদুলারি পার্ক, স্টুডিও-২১ ও অ্যাকাডেমিতে।

উপস্থাপনার সারল্যে একটা প্রতিবাদী ভাবনাকে তুলে ধরাই মাকরানি-র রচনাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিরোনাম ‘দ্য অ্যানাটমি অব অ্যান আননোন চেয়ার’। একটি চেয়ারের বিভিন্ন অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফ্রেমের উপর সাজিয়েছেন তিনি। শিল্পীর ভাবনায় চেয়ার হল ক্ষমতার উত্‌স। মানুষের অভীপ্সা বা উচ্চাকাঙ্খার প্রতীক। এই ক্ষমতারই বিশ্লেষণ প্রয়াস যেন এই রচনাটি। চেয়ার নিয়ে আরও দুটি কাজ রয়েছে। শরত্‌ রায়ের ভাস্কর্যধর্মী কাজটির শিরোনাম ‘পলিটিক্যাল পাওয়ার’। সিতাংশু জি মৌর্যর ইনস্টলেশনটির নাম: চেক সিল অন ডেলিভারি।

Advertisement

এই প্রদর্শনীতে বিকল্প-রূপকল্পধর্মী কাজ, ভিডিও ইত্যাদিতে ‘কনসেপ্ট-এর অভিনবত্ব যেমন পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও। দেবাশিস বারুই-এর ‘আই লাভ মাই হার্ট’ প্রযুক্তিগত উত্‌কর্ষের দৃষ্টান্ত। হৃদযন্ত্রের স্পন্দনকে উপস্থাপিত করেছেন অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে। বিপর্যয়ের পর পরিব্যাপ্ত নাগরিক বিস্তৃতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন দুর্বানন্দ জানা ‘ফরগেটফুলনেস ...’ শীর্ষক ভিডিও-ইনস্টলেশনে। ভাস্কর্যকে ইনস্টলেশনধর্মী করে তুলেছেন শান্তিনিকেতনের কিংশুক সরকার ‘স্কাল অব ফার্মার্স ডায়েড’ রচনায়। বাউলের একতারার সঙ্গে মিলিয়েছেন আজকের বিশ্বায়নজনিত ধ্বংসকে। ঐতিহ্য ও বিশ্বায়িত আধুনিকতার অসামান্য সমন্বয় এই রচনা।

সন্ত্রাসজনিত মৃত্যু ও হত্যা-এই ভাবনা থেকেই রূপায়িত হয়েছে সৌগত দাসের ‘অ্যামিড্স্ট দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’। আকাশচুম্বী অট্টালিকারা ছড়িয়ে আছে আবর্জনার মতো। তার মধ্যে ইতস্তত পড়ে আছে মৃত মানুষের দেহের ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরোগুলি। আজকের জীবন-জোড়া করুণ শূন্যতাকে রূপায়িত করেছেন অনিন্দ্য পণ্ডিত ‘লস্ট সিড’ ছবিতে। বইয়ের উপর রাখা আছে ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি তরবারি। এরকমই ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে বিমলানন্দ রায় তুলে ধরেছেন প্রজ্ঞা ও সন্ত্রাসের সংঘাত। প্রদীপ কুমার পাত্র তেপায়া একটি চেয়ারের আকৃতির উপর প্রতিস্থাপিত করেছেন দুমড়ে-মুচড়ে থাকা মৃত মনুষ্য শরীর। বিপুল কুমার সিরামিকসে করেছেন ‘সার্পেন্টাইন মাউন্টেন’ ভাস্কর্য।

মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে তুলে ধরেছেন বনমালী দাস ‘মি. অ্যান্ড মিসেস দাস’ রচনায়। স্বামী-স্ত্রী বসে আছে সামনে কুকুর। পিছনে দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবির ক্যালেন্ডার। অন্য পাশে শিব-পার্বতীর বাঁধানো ছবি। ঐতিহ্যগত আঙ্গিক নিয়ে নিবিষ্ট চর্চা করছেন এখনও অনেক তরুণ-শিল্পী। সোমা দাসের ‘ল্যান্ড ইটার’ অস্বচ্ছ জলরঙের ছবিটি এর দৃষ্টান্ত। নদীতে মাছ ধরছে গ্রামের মানুষ। ডাঙায় পশু-পাখির সমাবেশ। উপর থেকে আসছে একটি অতিকায় যন্ত্র, যা মৃত্তিকাকে খনন করতে উদ্যত। শর্মী চৌধুরীর টেম্পারাটিও উল্লেখযোগ্য।

অ্যাকাডেমিতে রাখা হয়েছে শুধু ছাপচিত্রের কাজ। জ্যোতির্ময় দলপতি-র গ্রামের ভিতর শহরের অনুপ্রবেশের এক আলেখ্য। স্বপন কুমার দাস করেছেন এক নগরের ছবি। স্থাপত্যের কারাগার রূপায়িত হয়েছে অনু গুপ্তের এচিং-এ।

মৃণাল কান্তি গায়েন গ্রামীণ প্রশান্তিকে রূপ দিয়েছেন ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে। শাকিলার কোলাজে গ্রামের সেই প্রশান্তিকে ভাঙছে বাইরের আলোড়ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন