চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...

ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের প্রতীক যেখানে গতি ও হিংস্রতা

স্টুডিয়ো ২১-এ অনুষ্ঠিত হল তরুণ শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষতরুণ শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি স্টুডিয়ো ২১-এ। দু’টি ভাস্কর্য এবং প্রায় ৩০টি ড্রয়িং ও পেইন্টিং নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ড্রিম উইভার’। গত কয়েক বছর যাবৎ এই শিল্পীর ছবি আমরা দেখে এসেছি বিভিন্ন সম্মেলক প্রদর্শনীতে, বিশেষত স্টুডিয়ো ২১ ও সিমা গ্যালারিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ২২:২৮
Share:

শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

তরুণ শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি স্টুডিয়ো ২১-এ। দু’টি ভাস্কর্য এবং প্রায় ৩০টি ড্রয়িং ও পেইন্টিং নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ড্রিম উইভার’। গত কয়েক বছর যাবৎ এই শিল্পীর ছবি আমরা দেখে এসেছি বিভিন্ন সম্মেলক প্রদর্শনীতে, বিশেষত স্টুডিয়ো ২১ ও সিমা গ্যালারিতে। এ বারের এই এককটি তাঁর ভাবনা ও কাজের বৈশিষ্ট্যকে সামগ্রিক ভাবে তুলে ধরল।

Advertisement

শিল্পী তাঁর সৃজন প্রক্রিয়াকে যে স্বপ্নের বুনন বলতে চেয়েছেন, তার একটা কারণ হয়তো এই যে, তাঁর ছবি বা ভাস্কর্যে বাস্তব স্বাভাবিকতা বা যথাযথ রূপ থেকে দূরে সরে গেছে, স্বপ্নে যেমন ঘটে থাকে। রূপান্তরণের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে কল্পরূপ বা ফ্যান্টাাসি। কল্পরূপ অনেক সময়ই হয়ে ওঠে শিল্পের একটি প্রয়োজনীয় প্রকাশভঙ্গি বা আঙ্গিকপদ্ধতি। সত্যের আরও গভীরে প্রবেশ করাই এর উদ্দেশ্য। আদিম শিল্পে বা আজও আদিবাসী শিল্পীদের কাজে এর প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। সেই উত্তরাধিকার সূত্রেই বিশ্বজুড়ে আধুনিকতাবাদী শিল্পে কল্পরূপের রূপান্তরণপদ্ধতি নানা ভাবে প্রযুক্ত হয়েছে। পাশ্চাত্য শিল্পে এক্সপ্রেশনিজম বা কিউবিজমে কল্পরূপের যে ব্যবহার, তার প্রধান উদ্দেশ্য জীবনের গভীরে প্রবেশ করে সত্যকে উন্মীলিত করা। ১৯২৪ সালে ফরাসি দেশে যখন সুররিয়ালিজমের সূচনা হল, তখন থেকেই কল্পরূপের একটা উৎস হিসেবে স্বপ্নের ভূমিকা গুরুত্ব পেল। এর পিছনে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ বা স্বপ্নবিশ্লেষণ পদ্ধতির কিছু অবদান রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যে হিংসা, সন্ত্রাস ও ধ্বংসের বাতাবরণ ছড়িয়ে পড়েছে, তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া থেকে জেগে উঠেছে সুররিয়ালিজমের স্বপ্নবিধৃত কল্পরূপ। পিকাসো বা দালির শিল্পকর্মে এর নিগূঢ় প্রকাশ আমরা দেখতে পাই।

কল্পরূপ বা সুররিয়ালিজমের আর একটি শান্ত রূপও আছে। সুকুমার রায়ের ‘বকচ্ছপ’, ‘হাঁসজারু’ বা ‘হাতিমি’-র প্রতিমাকল্প এই শান্ত কৌতুকের অন্যতম নিদর্শন। যদিও এর গভীরে সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ন প্রতিবাদও প্রচ্ছন্ন থাকে। রবীন্দ্রনাথের ছবি বা হেমন্ত মিশ্রের ছবির নিহিত সুররিয়ালিজমও অনেকটা সমধর্মী।

Advertisement

সত্যজিতের ছবি বা ভাস্কর্য প্রাথমিক ভাবে সুকুমার রায়কে মনে পড়ায়। বিভিন্ন প্রাণীর অবয়বকে মিলিয়ে সত্যজিৎ নানা কিমাকার প্রাণী সৃষ্টি করেন। তাতে কৌতুক আছে, কিন্তু নির্দোষ কৌতুক সৃষ্টিই তাঁর শেষ উদ্দেশ্য নয়। কৌতুকের আবরণেই তিনি সন্ত্রাসের গভীরে প্রবেশ করেন। এইখানেই তাঁর রচনা সাম্প্রতিকের সামাজিক তাৎপর্য পায়।

তাঁর ভাস্কর্য দুটি সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফাইবার গ্লাসে নির্মিত চিত্রিত এই রচনা দু’টি আয়তনে যথেষ্ট বড়। ভাবনা ও প্রকরণে স্বাতন্ত্র্যময়। একটির শিরোনাম ‘দ্য অ্যানিম্যাল’। এটি ঘোড়া ও পাখির সমাহার। দু’পায়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাণীটি। একটি পা উপর দিকে তোলা। বলিষ্ঠ শরীরেও ঘোড়ার আভাস। কেবল মুখটি পাখির, দীর্ঘ, তীক্ষ্ন ঠোঁটদুটি সারসপাখির মতো। হিংস্রতার আভাস রয়েছে তাতে। গতি ও হিংস্রতার সমন্বয়ে ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের প্রতীকী তাৎপর্য পায় রচনাটি। দ্বিতীয় ভাস্কর্যটির শিরোনাম ‘আ সুপারস্টার’। বৃহদাকার একটি দণ্ডায়মান ময়ূরের প্রতিমাকল্প এটি। পা দুটি অনেকটা মানুষের মতো। ট্রাউজার পরা। কোমরের বেল্ট ও পকেটেও যথেষ্ট ক্ষমতাদীপ্ত আত্মম্ভরিতার আভাস রয়েছে। মাথার ঝুঁটিতে সাজানো ময়ূরের মুখটি যথেষ্ট কৌতুকদীপ্ত ও সারল্যময়, মানুষের পরস্পর বিপরীত দ্বৈত সত্তার আভাস রচনাদু’টিতে।

ছবিগুলিতে এই দ্বৈত রূপের সমাহার ও রূপান্তরণ প্রক্রিয়া নানা ভাবে এসেছে। আপাত-কৌতুকের ভিতর দিয়েই প্রকট হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের বাস্তবতা। জলরং ও কালি-কলমে করা ‘দ্য পলিটিশিয়ান’। ছবিটি যেমন। মানুষ ও হাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক নেতার অবয়ব। মাথায় টুপি রয়েছে। চোখদুটি হাতির চোখের মতো, শুঁড়টি প্রলম্বিত। শরীরের গঠন পিস্তলের ব্যারেলের মতো। নির্দোষ কৌতুক রূপান্তরিত হয় তীক্ষ্ন সমালোচনায়। কালি-কলমে আঁকা ‘দ্য প্লেয়ার’ রচনাটিতে পাখির পা, মানুষের মাথা ও পশুর লেজের সমাহার ঘটেছে। এই সমাহার প্রায় সব রচনাতেই। ইঙ্গিত রয়েছে পাশবিক হিংস্রতার দিকে। কল্পরূপের ভিতর দিয়ে এই সন্ত্রাসকেই বিদ্ধ করতে চেয়েছেন শিল্পী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন