চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

গুহাচিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে ধ্রুপদী ঐতিহ্যের স্পন্দন

আকার প্রকার-এ অনুষ্ঠিত হল মণীন্দ্রভূষণের ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ।নব্য ভারতীয় ঘরানার শিল্পীদের কালানুক্রমিক ভাবে কয়েকটি প্রজন্মে ভাগ করা যায়। ১৮৯৭ সালে অবনীন্দ্রনাথের হাতে এই ঘরানার সূচনা। স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ এবং কেবল মাত্র তাঁকেই অভিহিত করা যায় এই ঘরানার প্রথম পথিকৃত্‌ বলে। ১৯০৫ সালে তিনি যখন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের উপাধ্যক্ষ হন, তখন এখানে তাঁর কাছে শিখে এই স্বদেশি আঙ্গিকের সাধনায় দীক্ষিত হন অনেক শিল্পী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

নব্য ভারতীয় ঘরানার শিল্পীদের কালানুক্রমিক ভাবে কয়েকটি প্রজন্মে ভাগ করা যায়। ১৮৯৭ সালে অবনীন্দ্রনাথের হাতে এই ঘরানার সূচনা। স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ এবং কেবল মাত্র তাঁকেই অভিহিত করা যায় এই ঘরানার প্রথম পথিকৃত্‌ বলে। ১৯০৫ সালে তিনি যখন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের উপাধ্যক্ষ হন, তখন এখানে তাঁর কাছে শিখে এই স্বদেশি আঙ্গিকের সাধনায় দীক্ষিত হন অনেক শিল্পী। নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখ শিল্পীর চর্চায় এই আঙ্গিক বিস্তার লাভ করে। তাঁদের বলা যায় দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী।

Advertisement

এই সব শিল্পীর কাছে শিক্ষালাভ এই ঘরানাকে যাঁরা আরও প্রসারিত করেছেন, তাঁদের বলা যেতে পারে তৃতীয় প্রজন্ম। সে দিক থেকে মণীন্দ্রভূষণ তৃতীয় প্রজন্মের শিল্পী। আবার স্থানগত ভাবে এই ঘরানার দুটি ধারা। প্রথম ধারাটি কলকাতা থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয় ধারাটি, বিশেষত তৃতীয় প্রজন্মের অনেক শিল্পীর চর্চা, বিকশিত হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে। ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ‘কলাভবন’ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২১-এ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পর ‘কলাভবন’ বিশ্বভারতীয় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যায়। সেখানে প্রথম শেখাতে শুরু করেন অসিতকুমার হালদার। ১৯২১ সাল থেকে নন্দলাল বসুর হাতেই অর্পিত হয় কলাভভন পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব। মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের শিল্পশিক্ষার শুরু শান্তিনিকেতনে প্রথমে অসিতকুমার, পরে নন্দলালের কাছে।

Advertisement

মণীন্দ্রভূষণের ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হল সম্প্রতি আকার প্রকার গ্যালারিতে দেবদত্ত গুপ্তের পরিকল্পনায়। খুবই প্রয়োজনীয় একটি উদ্যোগ এই প্রদর্শনী।

এক সময় যাঁদের চর্চার মধ্য দিয়ে স্বদেশচেতনা-সঞ্জাত আধুনিকতা বিকশিত হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই আজ বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছেন। মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্যি। চিত্রকলায় এবং শিল্পকলার ইতিহাসে তাঁর অবদান একাধিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত। প্রথমত নিজস্ব চিত্রচর্চার দিক থেকে, দ্বিতীয়ত শিক্ষক হিসেবে, তৃতীয়ত বাংলার বাইরে এবং বহির্ভারতে এই ধারাকে বিস্তৃত করার দিক থেকে, চতুর্থত শিল্পতাত্ত্বিক হিসেবে।

মণীন্দ্রভূষণ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৮ সালের জুন মাসে। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে তাঁর শিক্ষার শুরু। সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেখানেই অসিতকুমার হালদারের কাছে চিত্রশিক্ষারও সূচনা।

১৯৩১ থেকে ২২ বছর অধ্যাপনা করেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। সিংহলে থাকাকালে ওখানকার ভারতীয় উসের যে বিভিন্ন প্রাচীন শিল্পধারা সেগুলি তিনি নিবিষ্টভাবে অনুশীলন করেন। এই প্রাচীন ধ্রুপদী রীতি তাঁর নিজের ছবিতেও বিশেষ মাত্রা আনে।

আলোচ্য প্রদর্শনীতে তাঁর প্রায় সব ক’টি ধারার ছবিই রয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন গুহাচিত্র ও মন্দিরের চিত্র ও ভাস্কর্যের অনুকৃতিমূলক রচনা বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করে।

রেখার সেই ছন্দিত সুষমার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের স্পন্দন। শ্রীলঙ্কার সিগিরিয়া-র একটি ফ্রেসকো থেকে অনুকৃত টেম্পারায় করা বৌদ্ধ অনুষঙ্গের এক মানবীমূর্তির রূপায়ণ তাঁর ধ্রুপদী আঙ্গিক আত্তীকরণের অনবদ্য দৃষ্টান্ত। নিসর্গচিত্রে মণীন্দ্রভূষণের বিশেষ স্বকীয়তা রয়েছে।

হিমালয়ের পাহাড়ি নিসর্গগুলিতে তিনি চৈনিক ও জাপানি চিত্ররীতিতে সুন্দর ভাবে আত্মস্থ করেছেন। জলরঙে আঁকা শান্তিনিকেতনের উদাত্ত মুক্ত প্রান্তর ও দূরে তালগাছের সারি সমন্বিত একটি নির্জন নিসর্গে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছবির যে পরিমণ্ডল অনুভূত হয়, সেটি দূর প্রাচ্যের চিত্রশৈলী আত্তীকরণেরই ফল।

দুই শিল্পীই এই চিত্রশৈলী নিজেদের মতো করে আয়ত্ত করেছিলেন। পুরাণকল্পমূলক ছবিও ছিল কয়েকটি ‘কার্তিকেয়’, ‘ব্যাধের সঙ্গে রামের সাক্ষা’ ইত্যাদি। এখানে অবশ্য শিল্পী নন্দলালের রূপরীতির মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছেন।

মণীন্দ্রভূষণ নব্য-ভারতীয় রীতির আঙ্গিকের নানা দিক নিয়ে নিবিষ্ট চর্চা করেছেন, কিন্তু একে অতিক্রম করতে পারেননি, যেটা বিনোদবিহারী বা রামকিঙ্কর করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন