চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

গতানুগতিকতার বাইরেও নতুন ভাবনার ইঙ্গিত

বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষসম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘২৫ বছর পরে’— শিরোনামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। ২৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় স্নাতক-শিক্ষা শেষ করেছেন যাঁরা, সেই সব শিল্পী সম্মিলিত ভাবে আয়োজন করেছেন এই প্রদর্শনী। আর্ট কলেজের ১৫০ বছর পূর্ণ হল এ বছর, ২০১৪ সালে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:২০
Share:

সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘২৫ বছর পরে’— শিরোনামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল। ২৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় স্নাতক-শিক্ষা শেষ করেছেন যাঁরা, সেই সব শিল্পী সম্মিলিত ভাবে আয়োজন করেছেন এই প্রদর্শনী। আর্ট কলেজের ১৫০ বছর পূর্ণ হল এ বছর, ২০১৪ সালে। এই ঘটনাকে উদ্যাপন করাও এই সম্মেলকের একটি উদ্দেশ্য। ’৮৯ সালে পাশ করেছিলেন প্রায় ৬০-৬৫ জন শিল্পী। তার মধ্যে ৩৭ জন অংশ নিয়েছেন এই প্রদর্শনীতে। আর্ট কলেজে শিল্পশিক্ষা ধারার যে ঐতিহ্য ও বৈচিত্র আছে, তার প্রতিফলন এই প্রদর্শনীতে রয়েছে।

Advertisement

১৮৫৪ সালে চিৎপুরের গড়ানহাটায় প্রতিষ্ঠিত হয়েচিল ‘দ্য স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’। ১৮৬৪-তে সেটি ব্রিটিশ সরকারের তত্ত্বাবধানে আসে। ১৮৬৫-তে এর নাম হয় ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট’। ১৯৫১-তে তা কলেজে উন্নীত হয়। ১৯৮৯-এর আগে পর্যন্ত এটা ছিল ডিপ্লোমা কোর্স। ৮৯ থেকে তা ডিগ্রি কোর্সে উন্নীত হয়। আলোচ্য প্রদর্শনীতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই প্রথম স্নাতক মর্যাদাভুক্ত। ১৮৬৪ থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে আধুনিকতার বিভিন্ন পর্যায়। ১৯৪০-এর দশকের পর থেকে এর পাশাপাশি এসেছে আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজম। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এর গতি অব্যাহত ছিল। ১৯৯০-এর দশকের পর এসেছে উত্তর-আধুনিকতার ঢেউ। এখন সেটাও অবসিত হয়ে ‘সমকালীন’ বা ‘কন্টেম্পোরারি’র পর্যায় চলছে।

আলোচ্য প্রদর্শনীর শিল্পীরা যখন পাশ করে বেরিয়েছেন, তখনও উত্তর-আধুনিকতা বা কনসেপচুয়াল আর্টের ঢেউ এখানে পৌঁছায়নি। যদিও ১৯৮০-র দশকের অনেক শিল্পী কনসেপচুয়াল আর্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এই প্রদর্শনীতে আমরা দেখি মূলত আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী ধারা। আধুনিকের মধ্যে নব্য-ভারতীয় ধারার আঙ্গিকের চর্চা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বাভাবিকতাবাদী ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার আঙ্গিক আত্তীকরণের দৃষ্টান্ত। এ রকম কিছু কাজও ছিল যা কনসেপচুয়াল আর্টের বৈশিষ্ট্যকে ছুঁয়ে যেতে চেয়েছে।

Advertisement

আধুনিকতাবাদ ও উত্তর-আধুনিক ভাবনার সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত অনিত্য রায়ের ভাস্কর্য। এই প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলে গণ্য করা যায় তাঁর দুটি কাজকে। বিপুল আয়তনের এক নগ্ন মানবী শরীর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তাঁর দু’টি পা ও দু’টি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাশেই রাখা হয়েছে। আর একটি ইনস্টলেশনধর্মী রচনায় মেঝের উপর রাখা আছে ফাইবার গ্লাসে তৈরি দু’টি পা। সেই পদযুগল স্পর্শ করে একটি মাদুর পাতা রয়েছে। ভাস্কর্যে সমীর পাল, আশিস কুমার পাল ও আশিস কুমার দাস গতানুগতিকতার বাইরে নতুন ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

ভারতীয় ঐতিহ্যগত চিত্ররীতির চর্চা এই আর্ট কলেজের শিক্ষাধারার একটি বৈশিষ্ট্য। ১৮৯৭ সালে ই বি হ্যাভেল ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌথ উদ্যোগে ও শিক্ষকতায় যে চর্চা শুরু হয়েছিল, তা আজও প্রবহমান। দীপক করের জলরঙে করা ‘গঙ্গা’ ও ‘গণেশ’ পুরাণকল্পমূলক ভারতীয় রীতির সফল দৃষ্টান্ত। এই আঙ্গিকেই কাজ করেছেন চন্দ্রভানুু গিরি, বরুণ দেব, অভিশঙ্কর মিত্র ও প্রবীর কুমার দাস। স্নেহাংশু শেখর দাসের অ্যাক্রিলিকের তিনটি রচনা ‘কাপল’, ‘ড্রিম অব হর্স রাইডিং’ ও ‘আননোন রিলেশন’— ঐতিহ্যগত রূপরীতির সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। তাপস ঘোষাল যদিও পাশ্চাত্য রীতিতেই প্রশিক্ষিত, তবু ঐতিহ্যমুখিনতা তাঁর ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। গৌতম শর্মার গোধূলির আলোয় উদ্ভাসিত প্রান্তরের দু’টি নিসর্গ রচনায় অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা বিশেষ মাত্রা সঞ্চার করেছে।

এই আর্ট কলেজের জলরং চর্চার পরম্পরার সুনাম আছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে। সেই ধারাবাহিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে ছিল সজল সরকারের তিনটি জলরঙের ছবি। এর মধ্যে ‘রিদম’ শীর্ষক ছবিটিতে হাল্কা রঙের ছোঁয়ায় এঁকেছেন নর-নারীর যৌনমিলনের দৃশ্য। পেলবতার মধ্য দিয়ে আবেগের দৃপ্ততাকে বের করে এনেছেন সার্থকভাবে। ছাপচিত্রের ক্ষেত্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শিল্পিতা সেনের উড-কাঠ-লিনো ও এচিং-এর সমন্বয়ে করা ‘ইনডিপেন্ডেন্ট’ শীর্ষক ছবিটি। অন্ধকার ভেঙে জেগে ওঠা পাখির প্রতিমাকল্পটি বিশেষ ভাবে স্পর্শ করে। এছাড়াও প্রদর্শনীতে ছিলেন শিবশঙ্কর মানিক, বর্ণালি দাস, অমিত লাহা, অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অঙ্গনা চক্রবর্তী, বিধান গুহ প্রমুখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন