পুস্তক পরিচয় ২

‘ছদ্মবেশ ধারণ করা কোনও পাপকর্ম নয়’

‘বাংলা সাহিত্যে ছদ্মবেশকেন্দ্রিক কোনও গ্রন্থ সম্ভবত এই প্রথম.... ’, জানিয়েছেন নারায়ণ সামাট, ছদ্মবেশ/ রামায়ণ মহাভারত এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে-র (গাঙচিল, ৩৫০.০০) রচয়িতা। অতীত ভারতের রামায়ণ, মহাভারত, বা অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে সংঘটিত ঘটনাগুলির কুশীলবদের ছদ্মবেশ-কেন্দ্রিক যে সব নানান চরিত্র, তাদের বিশ্লেষণ লেখকের কলমে। আলোচনায় উঠে এসেছে রাজ্য-রাজনীতির উত্থান পতনে ছদ্মবেশ বিদ্যার সর্বার্থসাধকতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

মহারানি স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর (১৩০৪ বঙ্গাব্দ) ‘নব্যভারত’ পত্রিকার শোকসংবাদে লেখা হয়েছিল, ‘মহারানীর জীবনী অলিখিত। প্রতিমূর্তি কোনো ফটো-ছবিতে কেহ দেখে নাই— তবুও কেন বঙ্গের ঘরে ঘরে মহারানীর কথা?’ এর দশ বছর পর বিহারিলাল সরকার লেখেন মহারানী স্বর্ণময়ী/ অর্থাত্‌ মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের স্বর্গীয়া মহারানী স্বর্ণময়ীর জীবনী। একশো বছর পেরিয়ে সেই দুর্লভ জীবনী পুনর্মুদ্রণ করল বাংলার মুখ প্রকাশন (সম্পা: হরিপদ ভৌমিক, ১৬০.০০)। দীর্ঘ ভূমিকা ছাড়া সংযোজিত হয়েছে বিদ্যাসাগরের চিঠি, নানা সংশ্লিষ্ট তথ্য- সংবাদ, স্বর্ণময়ী স্বাক্ষরিত দলিল ও তাঁকে লেখা চিঠির রঙিন প্রতিলিপি।

Advertisement

‘বাংলা সাহিত্যে ছদ্মবেশকেন্দ্রিক কোনও গ্রন্থ সম্ভবত এই প্রথম.... ’, জানিয়েছেন নারায়ণ সামাট, ছদ্মবেশ/ রামায়ণ মহাভারত এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে-র (গাঙচিল, ৩৫০.০০) রচয়িতা। অতীত ভারতের রামায়ণ, মহাভারত, বা অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে সংঘটিত ঘটনাগুলির কুশীলবদের ছদ্মবেশ-কেন্দ্রিক যে সব নানান চরিত্র, তাদের বিশ্লেষণ লেখকের কলমে। আলোচনায় উঠে এসেছে রাজ্য-রাজনীতির উত্থান পতনে ছদ্মবেশ বিদ্যার সর্বার্থসাধকতা। যেমন ‘অর্জুন যথারীতি তাঁর বিখ্যাত গাণ্ডীব ধনু নিয়ে রথের সামনে শিখণ্ডীকে বসিয়ে ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে আসামাত্রই ভীষ্ম শিখণ্ডীকে দেখে অস্ত্র ত্যাগ করলেন। অর্জুন কালবিলম্ব না করেই মুহুর্মুহু বাণ মেরে ভীষ্মকে শরশয্যায় শুইয়ে দিলেন।... অশ্বত্থামার হাতে প্রাণ দেন পুরুষ ছদ্মবেশী নারী শিখণ্ডী ওরফে অম্বা।’ ধর্মীয় কাহিনিতে দেবদেবীদের ছদ্মবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে সংক্ষেপে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, সূর্য প্রমুখের। রামায়ণ ও মহাভারতে উল্লিখিত ঘটনা ও উপঘটনার সূত্রে চরিত্রাবলির ছদ্মবেশ ধারণের কারণ বিচারে লেখকের সিদ্ধান্ত: ‘বহু ক্ষেত্রে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, বহু ক্ষেত্রে আত্মরক্ষা বা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়োজনে, বহু ক্ষেত্রে অন্যের উপকারার্থে কুশীলবগণ নিঃস্বার্থ ভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন। অপরাধ জগতের জন্যে ছদ্মবেশ ধারণ করা ব্যতীত, অন্য কোনও কারণে ছদ্মবেশ ধারণ করা কোনও পাপকর্ম বা কোনও অন্যায় কর্ম নয়।’

‘স্তালিন সম্পর্কে যে ধরনের ভয়াবহ কানাঘুষো বিশ্ববিদ্যালয়, মামার বাড়ি, দিদিদের বাড়ির জমঘটে শোনা যাচ্ছিল, আমি সোভিয়েত রাষ্ট্র আর মার্কসবাদকে একাত্ম করে ফেলছিলুম। পাটনা থেকে যে বাঙালিরা, কম্যুনিস্ট হবার দরুন, রাশিয়ায় যাতায়াত করতেন, অনেকে সপরিবারে, তাঁদের তুলনায় আমরা ছিলুম ফেকলু, সাংস্কৃতিক আর আর্থিক, দুদিক থেকেই। কলকাতা থেকে যেসব বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা পাটনায় আসতেন, তাঁদের কাছে আমরা ছিলুম ছোটলোক, অসংস্কৃত ও খোট্টা। মার্কসবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে তখন থেকেই দোটানা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল আমার ভাবনাচিন্তায়।’— মলয় রায়চৌধুরীর স্মৃতি-আখ্যান ছোটোলোকের যুববেলা-র (রাবণ, ১২৫.০০) পরতে-পরতে জড়িয়ে জন্মসূত্রে বাঙালি, অথচ ঘটনাচক্রে পরবাসী এক যুবকের যন্ত্রণাবোধ, বা এক নিঃসঙ্গ সফরও বলা যেতে পারে। মলয় এর আগে লিখেছিলেন ছোটোলোকের ছেলেবেলা। তাঁর সাবর্ণ-অতীত আর হাংরি-ভবিষ্যতের মাঝখানের ধূসর পর্বটির ছায়াপাত এই যুববেলার আখ্যানটিতে।

Advertisement

বাঁকানো চাঁদের সাদা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে?
চাঁদের শতক আজ নহে তো,
এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে।
’—
‘কাস্তে’র কবি দিনেশ দাশ-কে (১৯১৩-’৮৫) নিয়ে কবিতীর্থ থেকে বেরিয়েছে রমাপ্রসাদ দে’র কবি দিনেশ দাস/ শতবর্ষে ফিরে দেখা (১৭৫.০০)। ‘নিবেদন’-এ জানিয়েছেন রমাপ্রসাদ ‘কবির একাধিক কবিতার প্রথম পাঠক আমি।’ এরপর কবিকে নিয়ে তাঁর দীর্ঘ আলোচনায় পরিশ্রমজীবী স্বদেশবাসীর সংগ্রামের প্রতি কবির যে পক্ষাবলম্বন তা পাঠককে খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন রমাপ্রসাদ, কবিকেই উদ্ধৃত করে: ‘জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়ে সাহিত্য শিল্প রচনা করা অসম্ভব। চাষি মজুর মধ্যবিত্তের পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে। দরকার হলে শিখতে হবে তাদের মুখের ভাষা, তাদের ছাত্র হিসেবে, মাস্টার হিসেবে নয়। আমরা যদি জনসাধারণের মাস্টারমশাই হয়ে যাই, তা হলে হাজার প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও জনগণ মনে প্রাণে আমাদের স্বীকার করবেন কি না সন্দেহ।’ গ্রন্থটির ‘উত্তর ভাগ’-এ রয়েছে কবি-পরিচয়, কবির প্রাসঙ্গিক কিছু কবিতা, কবির প্রতি শ্রদ্ধাপত্র, চিঠিপত্র। তাতে কবিকে লেখা জীবনানন্দ দাশের একটি চিঠি: ‘আপনার কবিতা আমাকে বহুদিন থেকে মুগ্ধ করে আসছে। প্রতিটি কবিতাই কোন না কোন গুণের জন্যে আমাকে টানে। সবের উপরে প্রসাদ গুণের সার্থকতা অনুভব করে আনন্দ পেলাম। জীবন-জিজ্ঞাসা আপনার কাব্যকে অনেক স্থানেই চিহ্নিত করেছে বটে, কিন্তু প্রায়ই তার স্নিগ্ধতা নষ্ট করতে পারেনি।’

বাঙালির সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আকরসূত্র-নির্ভর গবেষণা করে কী বিপুল পরিমাণ তথ্যের ভাণ্ডার তৈরি করে গিয়েছেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তা গবেষকরা জানলেও সাধারণ্যে তিনি বিস্মৃত। তাঁর দৌহিত্র বিশ্বনাথ রায় ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের সূত্র ধরে সযত্নে লিখেছেন সাহিত্যসেবক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (পারুল, ৬০.০০)। ‘পাঠক এই ব্রজেন্দ্র-আলেখ্যে একটি অচিত্রিত জীবনের সন্ধান পাবেন’, সূচনায় মন্তব্য করেছেন বারিদবরণ ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন