পুস্তক পরিচয় ২...

তথ্য কম হলে ক্ষতি নেই, ভুল থাকলেই বিপদ

বাংলার বিস্মৃত রাজধানী মুর্শিদাবাদ নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করতে গিয়ে রোজি লিউলিন-জোন্স শুরুটা করেছিলেন চমত্‌কার।

Advertisement

ইন্দ্রজিত্‌ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৪ ০৮:৩১
Share:

মুর্শিদাবাদ/ ফরগটন ক্যাপিটাল অব বেঙ্গল, সম্পা. নীতা দাস ও রোজি লিউলিন-জোন্স। মার্গ ফাউন্ডেশন, ২৮০০.০০

বাংলার বিস্মৃত রাজধানী মুর্শিদাবাদ নিয়ে একটি বই সম্পাদনা করতে গিয়ে রোজি লিউলিন-জোন্স শুরুটা করেছিলেন চমত্‌কার। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর (১৭০৭) কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে তিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজকর্মচারী একের পর এক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন, বাংলায় মুর্শিদকুলি খান, অযোধ্যায় বুরহান-উল-মুল্‌ক এবং হায়দরাবাদে আসফ জা। এর মধ্যে বাংলার নবাবি শাসন ছিল সব থেকে কম স্থায়ী, পঞ্চাশ বছরও নয়। বস্তুত বাংলার ‘পুতুল-নবাব’দের সঙ্গে ব্রিটিশরা যা করেছিল, তারই পুনরাবৃত্তি দেখা গেল অযোধ্যায়। ইতিহাসের এমন সন্ধিক্ষণে বই শুরু হলে পাঠককে নড়েচড়ে বসতেই হয়।

Advertisement

বইটির প্রকাশক মার্গ, দুই সম্পাদক নীতা দাস ও রোজি লিউলিন-জোন্স। লখনউ-এর ইমামবারা আর অন্যান্য স্থাপত্য নিয়ে নীতার বই আছে, আর রোজি লখনউ-এর স্থাপত্য, ইতিহাস, পুরনো ছবি, মানুষজন নিয়ে অনেকগুলি বই লিখেছেন, তাঁর সিটি অব ইলিউশন বা আ ফেটাল ফ্রেন্ডশিপ লখনউ চর্চায় অপরিহার্য। এমন দুই গবেষক যখন মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য সন্ধানের মতো অবহেলিত কিন্তু বিপুল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে হাত দেন, তখন ভরসা জাগে। আর সত্যিই তো, আপাতদৃষ্টিতে বইটি দেখলে সম্ভ্রম হয় বইকী। রোজি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে মুর্শিদাবাদ শহরকে দাঁড় করানোর পর রাজীব দুগার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অনালোচিত বিষয় তুলে এনেছেন, এই অঞ্চলের জৈন বণিকদের শেঠ থেকে জমিদারে রূপান্তরের ইতিবৃত্ত। এক দিকে প্রাচীন জগত্‌শেঠ পরিবার, অন্য দিকে পরবর্তী কালে আসা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের দুগার নাহার নওলাখা-দের কথা। মুর্শিদাবাদে এদের স্থিতি এবং মন্দির-নির্মাণ এই অঞ্চলকে কী ভাবে জৈন তীর্থে পরিণত করেছিল, আঞ্চলিক সংস্কৃতিতেই বা তাদের ভূমিকা কেমন ছিল, সেটাই দেখাতে চেয়েছেন রাজীব। রোজি আলোচনা করেছেন প্রাসাদ রাজবাড়ি ও অন্যান্য ভবনের কথা, নীতা বিশ্লেষণ করেছেন ধর্মীয় স্থাপত্য। আর মুর্শিদাবাদের বস্ত্রশিল্প নিয়ে জসলিন ধমিজা, চিত্রকলা নিয়ে জে পি লস্টি এবং হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি শিল্পবস্তু প্রসঙ্গে প্রতাপাদিত্য পালের লেখা প্রত্যাশিত ভাবেই বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ, বিশেষ করে শেষেরটি উস্‌কে দিয়েছে এ বিষয়ে নানা নতুন ভাবনা। বিভিন্ন সংগ্রহ থেকে নেওয়া হয়েছে বহু দুর্লভ ছবি, সদ্যপ্রয়াত অ্যান্টনি হ্যারিসন-এর আঁকা অনেকগুলি ছবি বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।

কিন্তু সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। তথ্য কম থাকলে ক্ষতি নেই, তথ্য ভুল থাকলে বিপদ বাড়ে। যেমন, রোজি বলেছেন (পৃ ১২) মকসুদাবাদকে দুটি নদীর মধ্যে অবস্থিত (অর্থাত্‌ একটি দ্বীপ) বলে দেখিয়ে বার্তোলোমিউ প্লেস্টেড যে ভুল করেন, ইউরোপীয় মানচিত্রকাররা সেই ভুলটাই অনুসরণ করছিলেন, শেষে টিফেনথেলার নিজে গিয়ে দেখে তা সংশোধন করেন। প্লেস্টেড যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ রয়েছে সার্ভেয়ার-জেনারেল জেমস রেনেল-এর মানচিত্রে (‘ম্যাপ অব দ্য কাশিমবাজার আইল্যান্ড’)। ভাগীরথী-পদ্মা-জলঙ্গির মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ডেই তো মুর্শিদাবাদের অবস্থান! এই বইতে দেখছি রিয়াজ-উস-সলাতিন মৌলভি আবদুস সালাম-এর লেখা (পৃ ১৮)। কিন্তু সালাম তো গোলাম হোসেন সলিম-এর বইটি ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন (১৯০২) মাত্র। রোজি দু’বার উল্লেখ করেছেন মুন্নি বেগমের চক মসজিদে পাঁচটি গম্বুজ আছে, এমনকী তিনি এ ক্ষেত্রে অজ্ঞাত শিল্পীর ভুলও (!) ধরেছেন (চিত্র ৮)। ঠিকই, গম্বুজের সংখ্যা পাঁচটি-ই, কিন্তু দুই প্রান্তের দুটি চতুষ্কোণ ভল্টকে হিসেব থেকে একেবারে বাদ দেওয়া চলে কি, বিশেষ করে যখন এই ধরনের ভল্ট মুর্শিদাবাদ স্থাপত্যে যথেষ্ট লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল? কাঠগোলার বাগানবাড়ির প্রবেশ-তোরণের সিংহ প্রসঙ্গে রোজি-র বক্তব্য, এগুলি আদৌ ব্রিটিশ-সিংহ নয়, ‘ইট্স ওরিজিন ইজ অলমোস্ট সার্টেনলি লোকাল...’। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, শুধু রোজি যদি একটু বাংলার মন্দির-টেরাকোটায় বা ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোয় ঘোড়ামুখো সিংহদের দেখতেন!

Advertisement

নীতা দাসের ধর্মীয় স্থাপত্য আলোচনার ক্ষেত্রেও কিছু গন্ডগোল থেকে গেছে। ৬৯ পৃষ্ঠায় টেরাকোটা ভাস্কর্যের ছবি দুটি কিরীটেশ্বরীর নয়, বড়নগরের চারবাংলা মন্দিরের। মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে ‘গৌড়’ থেকে কোনও স্থাপত্য-ধারা মুর্শিদাবাদে আসেনি (পৃ ৬০)। ঢাকা ও কলকাতার মাঝখানে মুর্শিদাবাদের ইসলামি স্থাপত্য কী ভাবে যোগসূত্র হয়ে উঠেছিল, তা দেখিয়েছিলেন ক্যাথরিন অ্যাশার (১৯৮৪)। স্থানীয় পুরাকীর্তির বিবরণ যত্ন করে তৈরি করেন বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৮২)। দুর্ভাগ্য, এঁরা কেউ এই বইয়ের ‘গ্রন্থপঞ্জি’তে ঠাঁই পাননি। জর্জ মিশেল পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর বইটির নাম ব্রিক টেম্পলস অব বেঙ্গল, ব্রিক-বিল্ট টেম্পলস নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন