পুস্তক পরিচয় ১

পার্টি-সমাজ কিন্তু একই রয়ে গেল

কার্টুনের মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতো ‘ভুল ছিল না’, এমন কথা দীর্ঘ বাম রাজত্ব সম্পর্কে সি পি আই(এম) দলের মুখপাত্ররা বলছেন না। বস্তুত তাঁদের মুহুর্মুহু ভুল স্বীকার নিয়েও কটাক্ষে মাতেন কেউ কেউ, যা আমার মনে হয় নিতান্তই অবান্তর।সম্প্রতি প্রকাশিত দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের গভর্নমেন্ট অ্যাজ প্র্যাকটিস বইখানি এই ভাবনাগুলিকে উসকে দিল।

Advertisement

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৩২
Share:

গভর্নমেন্ট অ্যাজ প্র্যাকটিস/ ডেমোক্র্যাটিক লেফট ইন আ ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া, দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৯৯৫.০০

সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে যখন মহাপরিবর্তন আসতে লাগল, তখন একটি কার্টুন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস মস্কোর রাস্তায় টুপি-হাতে ভিক্ষা চাইছেন, আর নীচে লেখা রয়েছে: ‘কিন্তু আমাদের তত্ত্বটা ভুল ছিল না’। চৌত্রিশ বছরের বাম জমানায় কোনটি ভুল ছিল, কোনটি ঠিক, তা নিয়ে বিদগ্ধজন তথা আপামর বঙ্গবাসীর আগ্রহ ও উত্তেজনা এখনও তেমন স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ দেখি না। এবং তা হওয়ার কারণও নেই এর গুরুত্বের নিরিখে। এক অর্থে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস তাঁদের তত্ত্ব নিয়ে কার্টুনটিতে যা বলছেন, তা ভুল বলা যায় না। কারণ, মার্ক্সবাদ এমন কোনও তত্ত্ব নয়, যা বিপ্লবের এবং পরবর্তী সমাজ গঠনের ব্লু-প্রিন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। অতএব ‘সমাজতান্ত্রিক’ নামাঙ্কিত কোনও রাজত্বের পতনে মার্ক্সবাদের ঠিক-ভুল প্রমাণিত হয় না।

Advertisement

কার্টুনের মার্ক্স-এঙ্গেলসের মতো ‘ভুল ছিল না’, এমন কথা দীর্ঘ বাম রাজত্ব সম্পর্কে সি পি আই(এম) দলের মুখপাত্ররা বলছেন না। বস্তুত তাঁদের মুহুর্মুহু ভুল স্বীকার নিয়েও কটাক্ষে মাতেন কেউ কেউ, যা আমার মনে হয় নিতান্তই অবান্তর। সম্প্রতি প্রকাশিত দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যের গভর্নমেন্ট অ্যাজ প্র্যাকটিস বইখানি এই ভাবনাগুলিকে উসকে দিল। দ্বৈপায়ন বর্তমানে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধানে যুক্ত। এই বইয়ে যেটি লক্ষ করার মতো, সিপিআইএম দলের মার্ক্সবাদে আস্থা বা বিচ্যুতি নিয়ে দ্বৈপায়ন অবান্তর প্রসঙ্গে যানইনি। চৌত্রিশ বছর সরকারে থেকে যে-সব নীতি প্রণয়নের ফলে বামফ্রন্ট কিছুটা সদর্থক সমাজ-পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছে, তার কোনওটাই ধ্রুপদী মার্ক্সবাদী প্রকল্প বলে দাবি করা যায় না। যেমন ভূমি সংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ। ক্ষমতার পিরামিডে নিম্নবর্গের অবস্থানটিকে খানিকটা তুলে আনতে এই প্রকল্প দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করা হয়। সমীক্ষা-ভিত্তিক গবেষণা থেকে তার সমর্থনও পাওয়া যায়। তাই দ্বৈপায়নের ফোকাস গভর্নমেন্ট অ্যাজ প্র্যাকটিস, তার উন্মোচন। এই উন্মোচন প্রক্রিয়ায় কিন্তু কোনও বিমূর্ত আদর্শ সমাজের ছবি মাথায় রাখার প্রয়োজন নেই। রাখলেই বার-বার মনে হবে, ‘দেকেচ, কী ডিজেনারেশন!’

সমাজ-অর্থনীতিতে নিরন্তর হরেক পরিবর্তন হতে থাকে। তার কোনগুলির জন্য সরকারকে এবং সরকারে অধিষ্ঠিত বিশেষ দলকে দায়ী করা যায় আর কোনগুলির জন্য করা যায় না, এ বিষয়ে কোনও জোরালো সিদ্ধান্তে আসা যারপরনাই কঠিন। সমাজবিজ্ঞানীরা মাথা খাটিয়ে, নানান পদ্ধতির আমদানি করে, তথ্য ঘেঁটে চেষ্টা চালিয়ে যান, কিন্তু গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তগুলি কখনওই প্রশ্নের অতীত কিংবা সর্বসম্মত হয়ে ওঠে না। হওয়া সম্ভবও নয়। দ্বৈপায়নের বইটিও সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পড়তে হবে। টেলিভিশনের কাজিয়ায় বক্তারা কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে বাম রাজত্বের যাবতীয় ‘খারাপ’ দিকগুলি রেফারেন্স হিসেবে এনে ফেলে যে কোনও ঘটনার সমর্থনে যুক্তি দেন। এই ডিসকোর্সে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের জন্য এই বই নয়।

Advertisement

পায়ন দেখাচ্ছেন, কী ভাবে একটি দল স্থানীয়ের সরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে একটি ‘পার্টি-সমাজ’-এর জন্ম দিল ধীরে ধীরে। ধরা যাক বিকেন্দ্রীকরণ। কথা ছিল, সরকার কেন্দ্র থেকে নেমে আসবে স্থানীয়ের কাছে। কিন্তু ক্রমশ যা দাঁড়াল, তা বলা যেতে পারে স্থানীয়ের সরকারিকরণ, সরকারের স্থানীয়করণ নয়। কথাটা খটোমটো শোনাতে পারে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। সরকার এবং পার্টি মিলেমিশে আমাদের চেনা সমাজটা কী ভাবে পার্টি-সমাজ হয়ে উঠল, তা প্রত্যেকেই নিজ অভিজ্ঞতার আলোয় বলে যেতে পারেন। দ্বৈপায়ন যেমন নির্দিষ্ট ভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের ভূমিকাটির ওপর আলো ফেলেছেন, তা চমকপ্রদ। তিনি দেখাচ্ছেন, স্থানীয় নেতা ও পার্টি-কর্মীদের শ্রেণিবিন্যাসটি বদলের সঙ্গে সঙ্গে পার্টির প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকা ক্রমশ কী ভাবে বদলে গেল। প্রথমে ছিল, স্থানীয় স্তরে পার্টির মুখ হিসেবে শিক্ষককুলের উত্থান। ২০০৬-০৭-এ দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ১ লক্ষ ৫৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের ৭৮ শতাংশই সিপিআইএম প্রভাবিত এবিপিটিএ-র সদস্য। এঁদের অনেকেই হয়তো স্রোতের বিরুদ্ধে ঝক্কি এড়াতে সদস্য হয়েছেন। কিন্তু এঁদের একটি বড় অংশ যে গ্রামাঞ্চলে পার্টির মুখ হয়ে উঠেছিলেন, সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। মানুষের কাছে শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতাকে হাতিয়ার করে দলের গুরুত্ব বাড়ানো যে কৌশল, তা সফল হয়েছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু দলের স্বার্থ রক্ষা হলে যে তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থও রক্ষা পায়, এই উপলব্ধি থেকে তাঁরা নিজেদের দলতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে নিলেন, তার ফল হল অন্য রকম। স্থানীয় সমাজে তাঁদের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তার মাটি আলগা হতে থাকল। দ্বৈপায়নের সমীক্ষা থেকে উঠে এসেছে, শিক্ষকতার আয়ের সঙ্গে পার্টি-ঘনিষ্ঠতা উদ্ভূত অন্য সুযোগ মিলিয়ে শিক্ষকের শ্রেণি-অবস্থানটি ক্রমশই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির থেকে দূরে সরে গেল। অন্য দিকে, শিক্ষক ছাড়াও পার্টি-ঘনিষ্ঠ অন্য শ্রেণির প্রতিনিধিরাও, যেমন মধ্য কৃষক কিংবা পঞ্চায়েতের সঙ্গে লেনদেনে যুক্ত অন্য পেশার লোকজনও পার্টির মুখ হয়ে উঠল। এই প্রক্রিয়াটি দ্বৈপায়ন বিজ্ঞানীর নির্লিপ্ততায় চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। চৌত্রিশ বছরের ঘটনাপ্রবাহকে ধরতে গেলে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বর্ণনাগুলি মিলেমিশে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, দ্বৈপায়ন সে বিপদ এড়াতে পেরেছেন। গবেষণামূলক পুস্তকের নিয়ম মেনে তিনি আন্তোনিয়ো গ্রামশির ‘প্যাসিভ রিভল্যুশন’ থেকে পিয়ের বোরদ্যু-র ‘সিম্বলিক ভায়োলেন্স’— এমন অনেক তাত্ত্বিক ধারণাই বিভিন্ন প্রসঙ্গে এনেছেন, উল্টেপাল্টে দেখেছেন। কিন্তু ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’-র হট্টগোলে পাঠককে দিশেহারা করার চেষ্টা একেবারেই করেননি। তত্ত্বটা ভাল না বুঝলেও ‘পার্টি-সমাজ’ বুঝতে আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

পাড়ার চ্যাংড়াদের নিত্যদিনের প্রধান বিনোদন ছিল পচাকে খেপিয়ে তোলা। আর কাজটা বিশেষ কঠিনও ছিল না। ‘পচাবাবুর টাটকা বউ’ বললে সে খিস্তির চরম ফোয়ারা ছোটাত। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে সে মোক্ষম অস্ত্রটি ছুড়ত: ‘পার্টিকে দিয়ে যখন মার খাওয়াব, দেখবি’। সে সময়ে কসবার অলিগলিতে এমন হুমকি (এ ক্ষেত্রে যদিও নির্বিষ) আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশেই ছিল। ‘পার্টি’ বলতে ক্ষমতাসীন প্রধান বাম দলটিকেই বুঝত সবাই। পচার মুখে পার্টির কথা স্বভাবতই চ্যাংড়াদের আমোদ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত। অকুস্থলে হয়তো মনাদা এসে পড়ে। মনাদা টিউশনি পড়ায় আর পার্টির ক্লাসে যায়। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে চ্যাংড়ারা চাটাইয়ে সাঁটা গণশক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা ছিল আশির দশক। পরবর্তী কালে এই চ্যাংড়ারা কেউ কেউ পুকুর বুজিয়ে, ফ্ল্যাট বানিয়ে পার্টির সম্পদ হয়ে ওঠে। মনাদা টিউশনির ওপরে উঠতে পারেনি। কালের নিয়মে পার্টির ক্লাসটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম যে ৩০.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তার মধ্যে ধরে নেওয়া যায় মনাদারটা আছে, পার্টির সম্পদদের নেই। তারা এখন অন্য পার্টির সম্পদ। ঢোঁড়াই চরিত মানস-এ ধাঙড়টোলা আর তাৎমাটুলির মানুষজনের মনোজগতে গাঁধীজি যেমন ‘গান্হী-বাওয়া’ হয়ে আবির্ভূত হন আর আচমকা বিলিতি কুমড়োর পৃষ্ঠতলে সবুজ-সাদায় দর্শন দেন, সে ভাবেই পচাদের মনোজগতেরও একটি কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে যায় হাতেগরম ন্যায়বিচারের সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠান। রেবণগুণী কুমড়োটাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে, তার পর চিৎকার করে ওঠে ‘লোহা মেনেছি’। মানে পরাজয় স্বীকার করছি। রেবণগুণী এক দিকে ‘গান্হী-বাওয়া’র কাছে ‘লোহা মানে’, আবার কুমড়োপৃষ্ঠে চিত্রার্পিত গানহী-বাওয়াকে দেখিয়ে পাবলিকের থেকে মদ খাওয়ার পয়সাও জুটিয়ে নেয়। সতীনাথ ভাদুড়ি কিন্তু কোথাও ন্যায়-অন্যায় ঠিক-ভুল নিয়ে নীতিকথার বিচ্ছুরণে যাচ্ছেন না। যে ব্যক্তিটি একই সঙ্গে লোহা মানে এবং গান্হী-বাওয়ার ছবি দেখিয়ে মদ খাওয়ার পয়সা জোটায়, তার সিপিএম-তৃণমূল হয় না। দ্বৈপায়নের একটি প্রধান উপপাদ্য হল, রামরাজত্বের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে পার্টি-সমাজের যে অবসান হল, তা বলা যায় না। হস্তান্তরিত হয়েছে বলা যায়। অথচ তৃণমূল কংগ্রেস পার্টিটি তেমন সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল নয় তাঁর মতে। তা হলে প্রশ্ন থেকে যায়— পার্টি-সমাজের মর্মবস্তুটি কি একই রয়ে গেল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement