পুস্তক পরিচয় ২

শাসিতদের নাগরিক হতে সাহায্য করবে

ক’দিন আগেই হাওড়া স্টেশনে দুজন যুবককে আটকে রাখা নিয়ে একটা নিরীহ প্রশ্ন করে রেল পুলিশের হাতে বেদম মার খেলেন এক ভদ্রলোক। ছাপোষা গরিব মানুষ। টাকার জোর বা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপত্তি নেই, নেই কোনও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ। উর্দিপরা দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তাঁর সাধ্যাতীত। অপমানের অসহায় জ্বালা বুকে বয়ে সে দিন বাড়ি ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০০:০২
Share:

ক’দিন আগেই হাওড়া স্টেশনে দুজন যুবককে আটকে রাখা নিয়ে একটা নিরীহ প্রশ্ন করে রেল পুলিশের হাতে বেদম মার খেলেন এক ভদ্রলোক। ছাপোষা গরিব মানুষ। টাকার জোর বা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপত্তি নেই, নেই কোনও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ। উর্দিপরা দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তাঁর সাধ্যাতীত। অপমানের অসহায় জ্বালা বুকে বয়ে সে দিন বাড়ি ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।

Advertisement

দেশের সংবিধান ও একরাশ আইনে আছে মানুষের নানান অধিকারের স্বীকৃতি। যাঁদের প্রভূত বিত্ত বা অন্য ক্ষমতা তাঁদের এ সব অধিকারের চাহিদা কম। এঁরা বড় উকিল রাখতে পারেন, পুলিশের বড় কর্তা কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে ফোন করতে পারেন। কর্পোরেট কুবেরদের তো কথাই নেই। যা চান, তা আদায় করে নেওয়ার বহু ব্যবস্থা ওঁদের থাকে। তবে আইন-অতিরিক্ত সুবিধার সহজলভ্যতা সত্ত্বেও আইনের যাবতীয় সুবিধা কড়ায়-ক্রান্তিতে আদায় করতেও ওঁরা ছাড়েন না।

এ ছাড়াও আছেন তাঁরা, যাঁদের প্রভূত প্রতিপত্তি নেই, কিন্তু অর্থ, শিক্ষা, চেনাজানা ও নানান সামাজিক সুবিধার বলে তাঁরা আইনি অধিকারভোগী, আইনি অধিকার সম্পর্কে কমবেশি সচেতন এবং অধিকার প্রয়োগের পন্থা সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল। এঁরা ‘যথার্থ’ নাগরিক। এঁরা জনমতকে কিছুটা প্রভাবিত করতে পারেন। এঁদের মতামতকে সরকার গুরুত্ব দেয়।

Advertisement

বাকিরা নেহাতই সাধারণ। এঁরা ‘যথার্থ’ অধিকারভোগী নাগরিক নন। এঁরা শাসিত। তবে, এ দেশে সরকার গড়তে গেলে তাঁদের মতও জোগাড় করতে হয়। তাই শাসিত হলেও তাঁদের খুশি রাখার প্রয়োজন থাকে। তা ছাড়া, এই শাসিত ও তাঁদের নাগরিক স্বেচ্ছাসেবকরা সরকারকে মাঝেমধ্যে জোর চাপে ফেলেন। কখনও সেই চাপের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলগুলিও যুক্ত হয়। এ সবের ফলে বেরিয়ে আসে সাধারণের অধিকার-প্রতিষ্ঠাকারী কিছু নীতি ও আইন।

এই সব আইনের কথা সংবাদমাধ্যমে কিছু পরিমাণে আসে। এগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক কাগজে বেরোয়, টিভিতে দেখা যায়। তবে, গণমাধ্যমের প্রসার এ দেশে সীমিত। ১২৭ কোটি মানুষের দেশে খবরের কাগজ পড়ে উঠতে পারেন মোটামুটি ২০ কোটি মানুষ। অবশ্য, টিভি-দর্শকের সংখ্যা নাকি ৭০ কোটির মতো। সে যা-ই হোক, এই গণমাধ্যম মানুষকে অধিকারসচেতন করার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা পালন করে, সেটা একটা প্রশ্ন। কারণ, গণমাধ্যম মন হরণের প্রতিযোগিতায় অবিরাম রত। তাই খবর ও রাজনৈতিক তরজায় লক্ষ্যও হর্ষ-রোমাঞ্চ। তার উপর রয়েছে খবরের গুরুত্ব সম্পর্কে গণমাধ্যমের নিজস্ব ধারণার প্রভাব এবং গণমাধ্যমকে বশে রাখতে আগ্রহী কায়েমি স্বার্থের চাপ। এমন পরিস্থিতিতে, প্রয়োজনীয় আইনি ও অধিকার-সংক্রান্ত তথ্য সাধারণ মানুষ কতটা পান, সে বিষয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক। আর যাঁরা সংবাদমাধ্যমের নাগালের বাইরে, তাঁদের কাছে কতটা কী পৌঁছয়, তাও অনুসন্ধানের বিষয়। এ জাতীয় অনুসন্ধান কিছু হয়েছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যোগ করে বলা যায় যে, মোটের উপর আইনি অধিকার সম্পর্কে শাসিতের জানার পরিধি বেশ সীমিত।

এই পরিধির সীমা অতিক্রমের প্রয়াসে সাম্প্রতিক সংযোজন আলোচ্য বইটি। লেখক নব দত্ত সুপরিচিত সমাজকর্মী। একটি দৈনিকে প্রকাশিত লেখাগুলিকে একত্র করে এই বই। মোটামুটি ভাবে ২০১০ সালের শেষের দিক থেকে ২০১৩ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে লেখা প্রবন্ধগুলি। একশোর ওপর প্রবন্ধকে বিষয় অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, পুর ও নগর উন্নয়ন সংক্রান্ত আইন ও অধিকার, পঞ্চায়েত, গ্রামোন্নয়ন ও ভূমি সংক্রান্ত আইন ও অধিকার, নারী ও শিশু সংক্রান্ত আইন ও অধিকার, আদিবাসী জনজাতি বনশ্রমজীবী সংক্রান্ত আইন ও অধিকার, শিল্প ও শ্রম-সংক্রান্ত আইন ও অধিকার, পরিবেশ আইন, প্রান্তিক মানুষের অধিকার ও আইন এবং বিবিধ। প্রবন্ধগুলিতে আছে আইনগুলির ব্যাখ্যা, আইন লঙ্ঘনের বৃত্তান্ত এবং আইন প্রয়োগের পথে নানান আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার আলোচনা। গণ-আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সাধারণবোধ্য ভাষা ও চিত্তাকর্ষক ভঙ্গির গুরুত্ব লেখক বোঝেন বলেই বোধ হয় বইটি শিক্ষণীয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অক্লেশপাঠ্য। প্রবন্ধগুলি সমাজকর্মী ও পরিবেশকর্মীদের কাজে লাগবে। আশা করা যায়, বইটি সাক্ষর সাধারণের অধিকার-শিক্ষণে সাহায্য করে শাসিতের নাগরিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে পুষ্ট করবে।

অধিকারের নানা ক্ষেত্র আলোচিত হয়েছে বলেই একটা অভাব বিশেষ করে চোখে পড়ে। সেট টপ বক্সের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে ক্রেতা সুরক্ষা আইন লঙ্ঘন করছে, সে বিষয়ে একটি প্রবন্ধ আছে, কিন্তু সাধারণ ভাবে ক্রেতা সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এ দেশে ক্রেতারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। ওষুধ থেকে খাদ্যদ্রব্য, প্রায় সব ক্ষেত্রেই যথাযথ আইনের অভাবের দরুন অথবা আইন থাকা সত্ত্বেও ক্রেতা ঠকছেন ও ভুগছেন। সাধারণ গরিব মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কারণ তাঁদের বেছে নেওয়ার সুযোগ কম। এই বিষয়ে আরও কিছু প্রবন্ধ থাকলে ভাল হত।

বইয়ের নির্ঘন্টটি পাঠকের কাজে লাগবে (ভুলক্রমে নির্ঘন্টে উল্লিখিত পৃষ্ঠাসংখ্যাগুলি ইংরেজিতে রয়েছে)। মুদ্রণপ্রমাদ নগণ্য। কাগজের মান ভাল, ছাপা স্পষ্ট। তবে প্রচ্ছদ আর বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে আর একটু ভাবনা ও যত্নের দরকার ছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন